বিশ্ববাণিজ্যে মন্দার প্রভাবে কমেছে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসার সংখ্যা, খালি থাকছে জেটি
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব বাণিজ্যে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরে কমে গেছে সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজের আসা-যাওয়া। এতে প্রতিদিনই বেশকিছু জেটি খালি থাকছে, এই সংকটের আগে ব্যস্ততার যে চিত্র ছিল সম্পূর্ণ উল্টো।
পণ্য খালাসে জেটিতে বার্থিং পেতে একটি জাহাজ আগে ৩ থেকে ৫ দিন অপেক্ষায় থাকতো। কিন্তু, বর্তমানে জাহাজ সংকটের কারণে অন-অ্যারাইভাল জেটি দিতে পারছে বন্দর কর্তৃপক্ষ, যা সংকটের মাত্রাও তুলে ধরে।
গত এক সপ্তাহে বন্দরের ১৯টি জেটির মধ্যে প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি জেটিতে জাহাজ বরাদ্দ দিতে পারছে না চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের তিনটি টার্মিনাল রয়েছে, এগুলো হলো- জেনারেল কার্গো বার্থ, চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল এবং নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল। এসব টার্মিনালে রয়েছে মোট ২০টি জেটি। সচল ১৯ জেটির মধ্যে ছয়টি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজের জন্য, অন্য ১৩টি কনটেইনার জাহাজের।
এনসিটি এবং সিসিটিতে জেটিতে নিয়মিত কন্টেইনার জাহাজ বার্থিং নিলেও জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি) তে জেটি খালি থাকছে। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় পরবর্তী ছয় মাসে জাহাজ আসার সংখ্যা কমেছে ১৪৯টি বা সাত শতাংশ। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে বন্দরে জাহাজ আসে ২২০১টি। প্রতি মাসে গড়ে জাহাজ আসার সংখ্যা ৩৫৪.৪২টি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে জাহাজ আসে ২,০৫২টি। অর্থাৎ, প্রতি মাসে গড় জাহাজ আসে ৩৪২টি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর অনেক বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমে যায়। তবে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ কমলেও কার্গো হ্যান্ডলিং সেই তুলনায় কমেনি, বরং বেড়েছে বলে জোর দিয়ে বলেন তিনি।
ডলার সংকটে গত বছরের অক্টোবর থেকে এলসি খুলতে সমস্যার মধ্যে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বিলাসপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি করে। কমে যায় আমদানি-রপ্তানি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বন্দরে জাহাজ বার্থিং, পণ্য খালাস, কন্টেইনার হ্যান্ডলিংসহ সার্বিক কার্যক্রমে। বিশেষত, চট্টগ্রাম বন্দরে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমে যায় ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৪ টিইইউ।
চট্টগ্রাম বন্দরে আসা ৪৫ শতাংশ জাহাজ হলো কনটেইনারবাহী, আর ৪৫ শতাংশ হলো বাল্ক ক্যারিয়ার। বাকি ১০ শতাংশ হচ্ছে ট্যাংকার জাহাজ। প্রায় ৭৫ শতাংশ জাহাজই বহির্নোঙ্গরে লাইটার জাহাজে খালাস করে। বাকি ২৫ শতাংশ জেটি ব্যবহার করে।
জাহাজের আকার-ভেদে আমদানিকারকদের ১২ থেকে ২০ হাজার ডলার ভাড়া দিতে হয়। একটি জাহাজকে তিনদিন অলস বসে থাকলে ৩৬ থেকে ৬০ হাজার ডলার অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হতো। বাড়তি এই ভাড়া শেষ পর্যন্ত পণ্যের মুল্যে যোগ হয়ে ভোক্তাদের বহন করতে হতো। কিন্তু, এখন অন- অ্যারাইভাল বার্থিং এর কারণে জাহাজের বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে না আমদানিকারকদের।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিকেএমইএ)-র পরিচালক মোহাম্মাদ শামসুল আজম টিবিএসকে বলেন, 'ইউরোপ-আমেরিকায় পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় গার্মেন্টস মালিকদের অর্ডার কমে গেছে। অর্ডার কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে।'
দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এছাড়া, দেশের আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনারের ৯৮ শতাংশই আনা-নেওয়া হয় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে।
চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজ থেকে পণ্য দুইভাবে খালাস হয়। সব কনটেইনার জাহাজের খালাস হয় জেটিতে। এছাড়া বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজগুলোর কিছু জেটিতে এবং বহির্নোঙ্গরে লাইটার জাহাজে খালাস করে। তেলবাহী ট্যাংকারগুলো তেল খালাস করে বন্দরের ডলফিন অয়েল জেটিতে।
এদিকে কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমে যাওয়ার প্রভাবে বিশ্বের ১০০ ব্যস্ততম বন্দরের তালিকা থেকেও পিছিয়ে পড়ে চট্টগ্রাম বন্দর। গত জুলাই মাসে প্রকাশিত লয়েডস লিস্ট এর তালিকা অনুযায়ী, ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৬৭তম। ২০২২ সালের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ছিল ৬৪তম।