কঠিন শর্তের দ্বিপাক্ষিক ঋণ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধকে কঠিন করে তুলতে যাচ্ছে
আগামী বছরগুলোতে ঋণ পরিশোধের বোঝা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের ব্যালান্স অভ পেমেন্টের ওপর চাপ বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কারণ নমনীয় শর্তের বহুপাক্ষিক ঋণের চেয়ে কঠিন শর্তের দ্বিপাক্ষিক ঋণ নেওয়া দ্রুত বাড়ছে।
দ্বিপাক্ষিক ঋণ সাধারণত বহুপাক্ষিক ঋণের তুলনায় কম নমনীয় হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ঋণের শর্তাবলি আলোচনার বা প্রয়োজনে পেমেন্ট পুনর্নির্ধারণের সুযোগ কম পেতে পারে।
এ ধরনের ঋণে সুবিধাজনক শর্ত সাধারণত বহুপাক্ষিক ঋণের চেয়ে কম থাকে। দ্বিপাক্ষিক ঋণের সুদের হার বেশি হয়, সেইসঙ্গে গ্রেস পিরিয়ডও পাওয়া যায় কম এবং এ ঋণের শর্তগুলোও আরও কঠিন হয়ে থাকে।
দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতারা প্রায়ই প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়ার ওপর শর্তারোপ করে, যার জন্য ঋণগ্রহীতাদের নির্দিষ্ট দেশ বা কোম্পানি থেকে ঠিকাদার নিয়োগ করতে হয়। অন্যদিকে বহুপাক্ষিক ঋণদাতারা সাধারণত উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণ করতে দেয়, ফলে ঋণগ্রহীতাও সুবিধামতো ঠিকাদার বাছাই করতে পারে।
তাছাড়া দ্বিপাক্ষিক ঋণে উপকরণ কেনার ক্ষেত্রে অন্যান্য শর্তও আরোপ করা হয়। যেমন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ঋণ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে নির্মাণসামগ্রীর ৮৫ শতাংশ কিনতে হবে ভারত থেকে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট বিদেশি ঋণে বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ঋণের হিস্যা ছিল ৫৯ শতাংশ; ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বহুপাক্ষিক সংস্থার ঋণের অংশ ছিল ৬৯ শতাংশ। এই সময়ে বাংলাদেশের মোট ঋণে দ্বিপাক্ষিক ঋণের হিস্যা ২৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশ হয়েছে।
এছাড়া, তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের দায় বেড়ে হয়েছে ৬২.৩১ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছরে মোট বৈদেশিক ঋণের দায় বেড়েছে ৬২ শতাংশ।
ইআরডির কর্মকর্তারা বলেন, বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় হওয়ায় ঋণ-দায় বাড়ছে। মেগা প্রকল্প ছাড়াও কোভিড পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার যে বাজেট সহায়তা নিয়েছে, তার কারণেও বৈদেশিক ঋণের দায় বেড়েছে বলে জানান তারা।
বৈদেশিক ঋণের দায় বাড়ার কারণে ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়বে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার ২.৬৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে। বর্তমানে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য সরকার যে ঋণ নিয়েছে, সেইসব ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হলে ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে বলে ধারণা করছে ইআরডি।
ইআরডির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে ঋণ পরিশোধ বেড়ে ৩.৫৬ বিলিয়ন ডলার হবে। আর ২০২৪-২৫ ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা বেড়ে হবে যাথাক্রমে ৪.২১ বিলিয়ন ও ৪.৭২ বিলিয়ন ডলার।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই এসেছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো বড় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে পাইপলাইনে বৈদেশিক ঋণ রয়েছে ৪৪.৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ ঋণের জন্য সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন যে, এই পরিবর্তন দেশের ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে এবং ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য দেশের ওপর আরও চাপ তৈরি করতে পারে।
ইআরডির তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট বৈদেশিক ঋণে বিশ্বব্যাংকের অংশ কমে হয়েছে ৩১.৩৪ শতাংশ, আগের অর্থবছরে যা ছিল ৩২.৬০ শতাংশ। যদিও এ সময়ে বিশ্ব্যাংকের ঋণের দায় ১৮.১২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১৯.৫৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। মাত্র দুই বছর আগে, ২০২০-২১ অর্থবছরে, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক বকেয়া ঋণে বিশ্বব্যাংকের অংশ ছিল ৩৬ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের মতোই বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের দায়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) হিস্যাও কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে মোট বৈদেশিক ঋণের দায়ে এডিবির অংশ ছিল ২৩.৮৮ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২২.৬৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের দায়ে জাপানের অংশ ১৭.৬৫ শতাংশ, রাশিয়ার অংশ ৯.৪৭ শতাংশ এবং চীনের অংশ ৮.৬২ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া মোট ঋণের দায়ে ২০১৬ সালে চীনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) অংশ বেড়ে ২.৪ শতাংশ হয়েছে।
ইআরডির তথ্য আরও বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সরকারের বৈদেশিক ঋণের দায় বেড়ে হয়েছে ৬২.৩১ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছর শেষে বৈদেশিক ঋণের দায় ছিল ৫৫.৬০ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ অর্থবছর আগে বৈদেশিক ঋণের দায় ছিল ৩৮.৪৭৫ বিলিয়ন ডলার।
শক্তিশালী পরিশোধ পরিকল্পনা জরুরি
এসব ঋণ, বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রো রেল, পদ্মা রেলওয়ে লিঙ্ক, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের মতো প্রায়-সমাপ্ত যেসব মেগা প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদেশি অর্থায়ন জড়িত, সেগুলো পরিশোধের জন্য পুনর্মূল্যায়ন, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনা করার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'উদ্বেগের কথা হলো, নমনীয় ঋণের অংশ কমছে, অনমনীয় ঋণের অংশ বাড়ছে। দ্বিপাক্ষিক ঋণের ক্ষেত্রে আর্থিক খরচ [ঋণ গ্রহণের সঙ্গে যুক্ত খরচ, সুদ ও অন্যান্য চার্জ] বাড়বে।'
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, 'বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ঋণ পরিশোধে লম্বা সময় পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ৩০ বছর পর্যন্তও ঋণ পরিশোধের সময় পাওয়া যায়। আবার ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত গ্রেস পিরিয়ডও থাকে। কিন্ত দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার বেশিরভাগ ঋণ ৩ থেকে ১৫ বছরে পরিশোধ করতে হয়। দ্বিপাক্ষিক ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধের বোঝাও বাড়বে।
'আবার দ্বিপাক্ষিক ঋণের ডাউন পেমেন্টও দিতে হয়, যা এই ঋণকে আরও ব্যয়বহুল করে তোলে। কাজেই দ্বিপাক্ষিণ ঋণ বাড়লে দেশের ব্যালান্স অভ পেমেন্টের [বিওপি] ওপর চাপ এবং বাজেটের আকার বাড়বে।'
জাহিদ হোসেন বলেন, বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ঋণের ক্ষেত্রে সবকিছু স্বচ্ছ থাকে। কিন্ত দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ঋণে সবকিছু স্বচ্ছ থাকে না।
'দ্বিপাক্ষিক ঋণের ক্রয় প্রক্রিয়াতে বিভিন্ন শর্ত থাকে। যেমন, ঠিকাদার নিয়োগের জন্য, প্রকল্পের উপকরণ কেনার জন্য শর্ত রয়েছে। ঋণদাতা দেশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ উপকরণ কিনতে হয়,' বলেন তিনি।
জাহিদ হোসেন বলেন, এ কারণে দ্বিপাক্ষিক অনমনীয় ঋণ যতটা সম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে, যদিও এ ঋণে ভূরাজনৈতিকসহ অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক বিষয় থাকে। একইসঙ্গে বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণও বাড়তে হবে।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, এ বছর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনেও বহুপাক্ষিক সংস্থার ঋণ বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ফলে আগামীতে বহুপাক্ষিক সংস্থার ঋণের অংশ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ৬.৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সরকার ঢাকা-চ্টগ্রাম হাইওয়ে ছয় লেন থেকে আট লেনে উন্নীত করা, ৫.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি-৫) সাউদার্ন রুট প্রকল্পের মতো বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এসব প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যে ঋণ পাওয়া গেছে।
বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের অর্থায়নের অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এছাড়া বৈদশিক ঋণে আরও কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ রয়েছে।
বর্তমান বৈদেশিক ঋণের দায়, পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক ঋণ, ডিজিপির আকার ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইআরডির একটি চলমান প্রকল্পের আওতায় আগামী তিন মাসের মধ্যে এই পর্যালোচনার কাজ করা হবে। এতে কী পরিমাণ ঋণ নিলে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে পড়বে না, কোন ধরনের প্রকল্পে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত হবে বা কোন প্রকল্প থেকে রিটার্ন আসবে, তা পর্যালোচনা করা হবে।
এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলে জানান ইআরডির কর্মকর্তারা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মানদণ্ড অনুযায়ী, যেকোনো দেশ তার ডিজিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ নিতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের অনুপাত ২০ শতাংশের কম।