কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নয়: আইএমএফ
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত পদক্ষেপগুলো কার্যকর নয় বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির মতে, প্রকৃত বাজার পরিস্থিতির ভিত্তিতে বিনিময় হার এবং অর্থ সরবরাহ কমাতে ঋণের উচ্চ সুদহার নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যর্থ হওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
বুধবার (৪ অক্টোবর) বাংলাদেশকে মঞ্জুর করা ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তগুলো রিভিউ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে বিশ্ব ঋণদাতা সংস্থাটির কর্মকর্তারা এমন মন্তব্য করেন।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক টিবিএসকে জানান, আইএমএফ রিভিউ বৈঠকে তাদের প্রধান শর্তগুলোর আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলোর কোনটা বাস্তবসম্মত হয়েছে এবং কোনটা যথার্থ ভূমিকা রাখেনি তা দেখিয়েছে।
তিনি বলেন, "আইএমএফ কর্মকর্তারা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট করেছে, যার ফলে ডলারের দাম বেড়েছে। এছাড়া গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ দেওয়ার জন্য স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অফ ট্রেজারি বিল) রেট করেছে। এগুলো করার মূল লক্ষ্য ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অথচ মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে।"
"আইএমএফ বলেছে, যে পরিমাণে এক্সচেঞ্জ রেট বাড়ার কথা সে পরিমাণে বাড়েনি এবং ঋণের সুদহারেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি, যার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি," যোগ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী, ঋণের হার নির্ধারণ করা হয় স্মার্ট রেটের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩ শতাংশ যোগ করে। বর্তমানে, স্মার্ট রেট ৭.২০ শতাংশ। সুতরাং, ব্যাংকগুলোর ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হলো ১০.২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, "আইএমএফ ঋণ অনুমোদনের সময় আমাদের কিছু শর্ত দিয়েছিল। এর মধ্যে বেশকিছু শর্ত পূরণ করা হয়েছে। দুই-একটি জায়গায় ব্যর্থতা আছে। রিজার্ভ কিছু কম আছে। রাজস্ব আহরণ কম হয়েছে। তবে অনেক কিছু বাস্তবায়ন করা হয়েছে।"
তিনি বলেন, "ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশের কথা ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করেছে। বিপিএম-৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ হিসাবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া, মুদ্রার বাজার-নির্ধারিত বিনিময় হার প্রবর্তন করা হয়েছে। সুদহারের নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে। তাদের দেওয়া যেসব শর্ত অর্জন হয়েছে তা জানানো হয়েছে। আর যেগুলো অর্জন হয়নি সেগুলো কেন হয়নি তাও জানানো হয়েছে।"
শর্ত পূরণ ও ব্যর্থতা নিয়ে আইএমএফের পক্ষ থেকে কী বলা হয়েছে– এমন প্রশ্নে মুখপাত্র বলেন, "বৈঠক কেবল শুরু হয়েছে। তারা (আইএমএফ) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে বসে আলোচনা করবে। প্রথমে তথ্য নিচ্ছে তারপর আবার বৈঠক করবে। আগামী ১৮ অক্টোবর শেষ বৈঠক, সেখানে তাদের মতামত জানাবে। আমরাও আমাদের বিষয়গুলো জানাবো।"
আইএমএফ-এর শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল জুনে নিট রিজার্ভ ২৪.৪৬ বিলিয়ন রাখা, সেপ্টেম্বরে.২৫.৩০বিলিয়ন এবং ডিসেম্বরে ২৬.৮০ বিলিয়নে উন্নীত করা।
এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিন ধরনের রিজার্ভের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। মোট গ্রোস রিজার্ভ– বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ও নিট রিজার্ভ। দুই ধরনের হিসাব (মোট গ্রোস রিজার্ভ, বিপিএম ৬) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করলেও প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে না। তবে প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য নিয়মিত আইএমএফকে জানাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের কম রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২১.১৫ বিলিয়ন ডলার।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ মঞ্জুর করেছে আইএমএফ। এরমধ্যে ৩.৩ বিলিয়ন বর্ধিত ক্রেডিট সুবিধা এবং বর্ধিত তহবিল সুবিধা ব্যবস্থার (এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি) অধীনে এবং বাকি ১.৪ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে নতুন স্থিতিস্থাপকতা এবং টেকসই সুবিধার (নিউ রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাস্টেইনেবল ফ্যাসিলিটি) অধীনে।
আইএমএফের এই ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে গত ফেব্রুয়ারিতে। দ্বিতীয় কিস্তি প্রদানের আগে ঋণের শর্তগুলো পর্যালোচনা করতে বুধবার বাংলাদেশে আইএমএফ মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ঢাকায় এসেছে আইএমএফ টিম। শর্তগুলো পূরণ হলে আগামী ডিসেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাবে বাংলাদেশ।
আজ বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকে যে বিষয়গুলো তুলে ধরবে তারমধ্যে রয়েছে– জলবায়ু সম্পর্কিত সবুজ অর্থায়ন, টেকসই অর্থনীতি ও সবুজায়নের নীতি বাস্তবায়ন, ক্যাপিটাল ফ্লাইট সংক্রান্ত উদ্বেগ, বাণিজ্যিক ঋণ, বৈদেশিক ঋণ, আর্থিক নীতির উপযুক্ততা ইত্যাদি।
বৈঠকের আলোচ্যসূচি অনুযায়ী, আগামী ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানকালে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে মোট ৭ বার বৈঠকে বসবেন।
এছাড়া, আইএমএফ কর্মকর্তাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরার পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক; যারমধ্যে রয়েছে– ফরেন এক্সচেঞ্জ ইন্টারভেনশন এবং আমদানি নিষেধাজ্ঞা, রপ্তানি আয়ে বিলম্ব, ক্যাপিটাল ফ্লাইট নিয়ে উদ্বেগ, সাম্প্রতিক কর্মক্ষমতা এবং একইসঙ্গে ঝুঁকি ও নতুন নিয়ম-নীতির সামগ্রিক মূল্যায়ন চিত্র।