অবরোধ-হরতালে সাপ্তাহিক ছুটিতেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা চট্টগ্রামে
বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধ-হরতালে ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। গত সপ্তাহ থেকে দফায় দফায় অবরোধ-হরতালে শিল্পকারখানার উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাই আর্থিক ক্ষতি কমাতে এবং ঝুঁকি এড়াতে পণ্য পরিবহনে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তারা। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য ডেলিভারির তথ্যেও এমন চিত্র দেখা গেছে।
দেশের শীর্ষ রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম। প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) তপন সেনগুপ্ত টিবিএসকে বলেন, "কোভিড-১৯, তৎপরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলার সংকটে এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়িক সংকট চলছে। এরমধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে চলমান হরতাল-অবরোধ।"
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেলেও ডলার সংকটে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলো স্থবির হয়ে পড়ায় চাহিদা কমে ইস্পাতের উৎপাদন কমে গেছে ৩০ শতাংশ।
এরমধ্যে চলমান অবরোধ-হরতালে বিএসআরএম'র ইস্পাত পণ্যের বিক্রি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি হচ্ছে তাতেও আবার পরিবহনে বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কারণ দূরপাল্লার পরিবহন খরচ প্রায় ২০-২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এরপরও ঝুঁকির কারণে অনেক পরিবহন মালিক-চালক পণ্য পরিবহন করতে রাজি হচ্ছে না।
তাই নিরাপদে পণ্য ডেলিভারি ও পরিবহনে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
হরতাল-অবরোধে এমএস রডের বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন কেআর গ্রুপের চেয়ারম্যান সেকান্দার হোসেন টিংকু। তিনি টিবিএসকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে দিনে প্রায় ১৫০ টন রড বিক্রি হলেও তা এখন ৮০ টনে নেমে এসেছে। এর প্রভাবে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে ইস্পাতের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ বিক্রি অনেকটা বন্ধ রয়েছে বলে জানান এই উদ্যোক্তা।
দিনে প্রায় ১২ হাজার ব্যাগ সিমেন্ট উৎপাদন ও বিপণন করে এস আলম সিমেন্ট। কিন্তু অবরোধ-হরতালে তাদের বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ডিজিএম শফিকুল ইসলাম। হরতাল-অবরোধে সড়কে গাড়ি পুড়িয়ে দেয়ায় জনমনে আতঙ্ক ও পণ্য পরিবহন ঝুঁকির কারণে বিক্রি কমেছে বলে দাবি করেন তিনি।
খাতুনগঞ্জের আসাদগঞ্জ এলাকার পাইকারি রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এসএম কামরুজ্জামান বলেন, "স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম-সিলেট ১৩ টন পণ্য পরিবহনের ভাড়া সর্বোচ্চ ১৭ হাজার টাকা। হরতাল-অবরোধে এখন সেই ভাড়া দাঁড়িয়েছে ২২-২৩ হাজার টাকা।"
তিনি বলেন, "কিছু গাড়ি বাড়তি ভাড়া নিয়ে রাতে পণ্য পরিবহন করলেও বেশিরভাগ গাড়ি চলছে ছুটির দিনগুলোতে। তবে ছুটির দিনে পণ্য পরিবহনেও গাড়িগুলো পণ্য ডেলিভারি দিয়ে আবার নিরাপদে ফিরে আসতে পারবে কি না সেই চিন্তা করতে হচ্ছে।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাতুনগঞ্জের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জানান, গত এক সপ্তাহে ব্যাংকের লেনদেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৪০-৫০ শতাংশ কম হয়েছে। বাজারে দূরদূরান্তের গাড়ি প্রবেশ না করায় বিক্রি কমে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে।
ক্রমাগত ব্যাহত হচ্ছে বন্দরের ডেলিভারি কার্যক্রম
তিন দফায় বিএনপি, জামায়াতের ডাকা ছয় দিনের হরতাল-অবরোধে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার ডেলিভারি ও হ্যান্ডলিং কার্যক্রম। এই কর্মসূচীর প্রভাবে বন্দর থেকে কন্টেইনার ডেলিভারি সংখ্যা নেমে এসেছে দুই হাজারে। অর্থাৎ ডেলিভারি কমেছে প্রায় অর্ধেক। অবরোধকালীন সময়ে বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি নিতে আমদানিকারকরা শংকার মধ্যে রয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে আমদানিকারকরা পণ্য ডেলিভারিতে সরকারী ছুটি কিংবা অবরোধ নেই এমন দিনকেই বেছে নিচ্ছেন। ওই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ডেলিভারি বেড়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশেরও বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্র দেখা গেছে।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিদিন তিন হাজার থেকে চার হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে; এবং পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান এবং মোটরচালিত যান পণ্য সংগ্রহ করতে বন্দরে প্রবেশ করে।
আমদানিকারকদের ভাড়া পরিশোধ করার আগে তাদের কন্টেইনারগুলো জাহাজ থেকে আনলোড করার পরে চার দিনের গ্রেস পিরিয়ড দেওয়া হয়। এই প্রাথমিক সময়সীমা অনুসরণ করে, আমদানিকারকদের প্রথম সপ্তাহে ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনারের জন্য দৈনিক ৬ ডলার করে চার্জ করা হয়।
২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনারের জন্য দৈনিক এই ফি দ্বিতীয় সপ্তাহে দ্বিগুণ হয়ে ১২ ডলার হয়ে যায় এবং একই ধারায় ২১ তম দিন থেকে তা বেড়ে ২৪ ডলারে দাঁড়ায়।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে দিনের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হিসাব ধরা হয় আগের দিন সকাল আটটা থেকে পরদিন সকাল আটটা পর্যন্ত। সেই হিসেবে গত ২৭ অক্টোবর বন্দরে কন্টেইনার ডেলিভারি হয় ৪১৩২ টিইইউ। এরপর হ্যান্ডলিং সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে। হরতালের প্রভাবে ৩০ অক্টোবর কন্টেইনার ডেলিভারি হয় ২১০৬ টিইইউ।
একদিনের হরতাল শেষে ৩১ অক্টোবর অর্থাৎ ৩০ অক্টোবর সকাল ৮টা থেকে ৩১ অক্টোবর সকাল ৮টা পর্যন্ত কন্টেইনার ডেলিভারি হয় ৪১০৫ টিইইউ। এর পরবতী দুই দিনে কন্টেইনার ডেলিভারি নেমে আসে তিন হাজারের নিচে। ৩ নভেম্বর ডেলিভারি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেড়ে ৫৪৫১ টিইইউ ডেলিভারি হয়। সবশেষ দুই দিনের অবরোধের প্রভাবে ৬ নভেম্বর (৫ নভেম্বর সকাল ৮টা থেকে ৬ নভেম্বর সকাল ৮টা) কন্টেইনার ডেলিভারি হয় ১৯৯২টি।