তিন নতুন পণ্যে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ পরিকল্পনা পিএইচপি’র
বাজারে তিনটি নতুন পণ্য – বেন্ডিং গ্লাস, ফাইবারগ্লাস নেট ও অ্যালুমিনিয়াম ল্যাডার – আনতে চায় দেশের শীর্ষস্থানীয় গ্লাস প্রস্তুতকারক পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। পণ্যগুলো উৎপাদনে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগও করবে।
ব্যবসার এই সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে পিএইচপি চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ডে তিনটি নতুন কারখানা গড়ে তুলছে।
নতুন এ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাজার গবেষণা করেছে কোম্পানিটি। এর মাধ্যমে তারা সারাদেশের ১০ হাজার আসবাব প্রস্তুতককারককে চিহ্নিত করেছে, যাদের রয়েছে এ তিন পণ্যের চাহিদা।
টি-টেবিলের মতোন আসবাব তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বেন্ডিং গ্লাস। ছোটখাট ফার্নিচার প্রস্তুতকারকদের এ পণ্যের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার বর্গফুট বেন্ডিং গ্লাস উৎপাদনে সক্ষম একটি কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে পিএইচপি'র।
এই পদক্ষেপের আরেক উদ্দেশ্য আমদানি-নির্ভরশীলতা কমিয়ে এ পণ্যের দাম ৬ থেকে ৭ শতাংশ হ্রাস।
বর্তমানে ৫ থেকে ১০ হাজার বর্গফুট চাহিদার বিপরীতে পরিকল্পিত কারখানার সক্ষমতা বেশি হলেও, পিএইচপি চাহিদা বুঝে উৎপাদন করবে, ফলে প্রয়োজন অনুসারে উৎপাদন বাড়াতে বা কমাতে পারবে।
পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমীর হোসেন টিবিএস'কে জানান, আগামী ছয় মাসের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে বেন্ডিং গ্লাস উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কোম্পানিটি। ইতোমধ্যেই দরকারি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
ফাইবারগ্লাস নেট উৎপাদনের জন্য ১০০ টন সক্ষমতার একটি নতুন ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা করছে প্রতিষ্ঠানটি, চাহিদার ভিত্তিতে এটি পরে সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও রয়েছে।
আমীর হোসেন বলেন, ফাইবারগ্লাস উৎপাদনে আমরা চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার করব। প্রচলিত এমএস (মাইল্ড স্টিল) বা এসএস (স্টেইনলেস স্টিল) দিয়ে তৈরি জালির তুলনায় ফাইবার গ্লাস নেট মরিচা প্রতিরোধ ও দামের দিক দিয়েও টেকসই ও ব্যয়-সাশ্রয়ী।
এ পণ্য ভবনের জানালায় মশকরোধী জালি হিসেবে বা মশারি তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে।
কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ব্যাপক হওয়ায়, মশকরোধী জালির দাম বেড়ে গেছে। তারা আশা করছেন, স্থানীয়ভাবে এ পণ্য উৎপাদনের পর দাম অন্তত ১০ গুণ সাশ্রয়ী করা যাবে।
এ ছাড়া, অ্যালুমিনিয়াম ল্যাডার বা মই এরও একটি উৎপাদন ইউনিট গড়ে তুলবে পিএইচপি। এ পণ্যের স্থানীয় বেশকিছু উৎপাদক বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠান থেকেই কাঁচামাল কিনছে।
আমীর হোসেন বলেন, বর্তমানে আমরা অ্যালুমিনিয়ামের মই প্রস্তুতকারকদের কাছে কাঁচামাল সরবরাহ করছি। তাই এটি সরাসরি উৎপাদনের ইউনিট স্থাপনের ক্ষেত্রে কৌশলগত সুবিধা আছে।
তিনি বলেন, '২০০৫ সালে বাণিজ্যিকভাবে গ্লাস উৎপাদিনে যাওয়া ছিল চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু, আমরা একটি গ্লাসের বাজার তৈরি করতে পেরেছি, দেশের অর্থনীতি বড় হতে থাকায়– নতুন পণ্যেরও তেমন বাজার তৈরি হবে বলে আমরা মনে করি।'
পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজের সম্প্রসারণ
২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ২৪ দশমিক ২৭ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ। এজন্য বিনিয়োগ করা হয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। দেশের ৪০ শতাংশ ফ্লোট গ্লাসের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা কোম্পানিটির রয়েছে।
২০০৫ সালে প্রথম বাংলাদেশ থেকে গ্লাস রপ্তানি করে পিএইচপি। ২০০৮ সালে কোম্পানিটি উচ্চমানের সিলভার মিরর উৎপাদনের একটি কারখানা নির্মাণ করে, যেটির সিঙ্গেল-শিফট উৎপাদন সক্ষমতা ৭ লাখ বর্গমিটার।
২০১০ সালে মাসিক ৮০০ টন উতপাদন্স সক্ষমতার একটি কারখানা স্থাপন করে পিএইচপি। তারাই বাংলাদেশের একমাত্র কোম্পানি যারা একই ছাদের নিচে অ্যালুমিনিয়াম ও গ্লাস পণ্য উৎপাদন করছে। চতুর্থ প্রজন্মের শিল্পযন্ত্রের স্পাটারিং কোটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা গ্লাস উৎপাদন করছে।
২০১২ সালে পিএইচপি একটি গ্লাস প্রসেসিং প্ল্যান্ট স্থাপন করে, যেখানে টেম্পারড গ্লাস উৎপাদন শুরু করে।
২০২১ সালে কোম্পানিটি ১০ ধরনের রিফ্লেক্টিং গ্লাস উৎপাদন শুরু করে, যা দিয়ে তারা বাজার চাহিদার ৫০ শতাংশ ধরে ফেলে। এর আগে, শুধুমাত্র দুই ধরনের – গাঢ় নীল ও গাঢ় সবুজ – রিফ্লেক্টিভ গ্লাস বাংলাদেশে পাওয়া যেত।
২০২১ সালে পিএইচপি ইনসুলেটিং গ্লাস বা সাউন্ডপ্রুফ গ্লাস বাজারে আনে। এরপর চলতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা আরেকটি নতুন পণ্য – ৫১ ধরনের চমৎকার ডিজাইনের গ্লাস ডোর বাজারে এনেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে দৈনিক গ্লাসের চাহিদা ৮০০ থেকে ১ হাজার টন। আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে যা বেড়ে ২ থেকে আড়াই হাজার টনে পৌঁছানোর প্রত্যাশা রয়েছে।
২০১৯ সালে ক্লিয়ার গ্লাস উৎপাদন সক্ষমতার আধুনিকায়ন করে তা দৈনিক ১৫০ টন থেকে ৩০০ টনে উন্নীত করে পিএইচপি।
ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ফিলিপাইনে প্রতি মাসে গড়ে তারা ৮০০ টন গ্লাস রপ্তানিও করছে।
এ ছাড়া, ৫০০ টন উৎপাদন সক্ষমতার একটি অ্যালুমিনিয়াম কারখানা পরিচালনা করছে পিএইচপি, যেটির অন্তত ৩৫০ ধরনের ডিজাইনের পণ্য উৎপাদনের প্রোডাক্ট প্রোফাইল আছে। বর্তমানে দেশে অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের মাসিক চাহিদা ৪ থেকে ৫ হাজার টন।
মোহাম্মদ আমীর হোসেন বলেন, 'অর্থনৈতিক উৎপাদনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে গ্লাস ব্যবহারের। বাংলাদেশের উন্নয়নে আস্থাশীল একটি আশাবাদী প্রতিষ্ঠান হওয়ায়– করোনা মহামারি পরবর্তী সময়েও পিএইচপি চারটি নতুন পণ্য বাজারে এনেছে। এভাবে আমরা জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চাই।'