খেলাপির সংজ্ঞা থেকে বাঁচতে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি চায় বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো
খেলাপি নীতিমালায় গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকতে চায় বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। চলমান ডলার সংকট, ভর্তুকির অর্থ যথাসময়ে না পাওয়া, এসব কাটিয়ে সহজে ঋণ সুবিধা পেতে এমন দাবি জানিয়েছে তারা।
গত ২ নভেম্বর বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি দিয়ে এমন দাবি জানায়।
বিআইপিপিএ এর সভাপতি ফয়সাল খান স্বাক্ষরিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রেরিত চিঠিতে বলা হয়, "বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোকে যাতে গ্রুপ বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শ্রেণী থেকে বাদ দেওয়া হয় ও তাদেরকে স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, এমন একটি নীতি প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় সার্কুলার জারি করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি আমরা।"
"এটি করা হলে তারা ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিতে সক্ষম হবে, এবং এতে করে নির্বিঘ্নে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করা যাবে," বলা হয় চিঠিতে।
বিদ্যমান ব্যাংকিং নীতিমালা অনুযায়ী, কোন খেলাপি গ্রাহক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ সুবিধা পাবেন না। তবে খেলাপি গ্রাহকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন গ্রুপ কিংবা প্রতিষ্ঠান ঋণ সুবিধা পাবে। সেক্ষেত্রে শর্ত হলো- উক্ত খেলাপি গ্রাহক ইচ্ছাকৃত খেলাপি যেন না হন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "গত ২৬ জুন সরকার নতুন গেজেটে খেলাপি গ্রাহকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুযোগ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠান যেন ইচ্ছাকৃত খেলাপি না হয় এমন ব্যাখ্যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে হবে।"
তিনি বলেন, "কোন গ্রাহক যে ইচ্ছাকৃত খেলাপি না এমন যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এনওসি দিবে।"
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আরও সহজ সুবিধা চাচ্ছে।
স্বাধীন বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম টিকিয়ে রাখার জন্য এ ধরনের পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে ফয়সাল খান টিবিএসকে বলেন, "ঋণের অ্যাক্সেস ছাড়াই স্বাধীন বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর সাত মাস পর্যন্ত বিলম্বিত পেমেন্টের মধ্যে পড়তে হয়। এমন হতে থাকলে এ সংস্থাগুলো কিভাবে তাদের কার্যক্রম চলমান রাখবে?"
বিআইপিপিএ এর সাবেক সভাপতি ইমরান করিম টিবিএসকে বলেন, "বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুতের মূল্য বাবদ রাষ্ট্রের কাছে অনেক টাকা পায়। এই টাকা বকেয়া থাকার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না।"
তিনি বলেন, "সরকার অবগত রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কেন ঋণ দিতে পারছেন না। নতুন করে খেলাপির ব্যাখ্যা ও নতুন প্রক্রিয়ায় যাওয়া মনে হচ্ছে দরকার নেই।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা বলেছি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো যেন স্বাধীন সতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পায়। এর কারণে যেন বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানের মালিকের অন্য প্রতিষ্ঠাণের ক্ষেত্রে ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা প্রজেয্য না হয়।"
বিআইপিপিএ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া চিঠিতে বলেছে, গত দুই বছরে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও আর্থিক সংকট বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলেছে। কার্যকরী মূলধনের ঘাটতি এবং ডলারের সংকট এক্ষেত্রে প্রধান কিছু সমস্যা। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) থেকে অর্থ পরিশোধে দীর্ঘ বিলম্ব বিআইপিপিএ সদস্যদের জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। বাজারে ডলারের তীব্র সংকটের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি সংগ্রহ করা বিশেষভাবে কঠিন হয়ে পড়েছে।
"বাংলাদেশ প্রাইভেট সেক্টর পাওয়ার জেনারেশন পলিসি অনুযায়ী স্পেশাল পারপাস ভেহিকেল (এসপিভি) হিসেবে গঠিত আইপিপি কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছে। এর ফলে ক্যাশ ফ্লো'র চ্যালেঞ্জ, ঋণের শ্রেণিবিন্যাস এবং এলসি খোলার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয়েছে।"
খেলাপি ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত সুদ চার্জ মওকুফ চায় বিআইপিপিএ
ব্যাংকগুলো এখন ওভারডিউ এবং ক্লাসিফায়েড ঋণের জন্য সর্বোচ্চ ১.৫% সুদ নেয় পেনাল্টি হিসেবে।
ভাল ঋণগ্রহীতাদের উৎসাহিত করতে এবং খারাপ বা ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের নিরুৎসাহিত করতে খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক এ সুদ আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দেওয়া চিঠিতে খেলাপি ঋণের উপর এ ধরণের দণ্ড সুদ মওকুফের আবেদন জানায় বিআইপিপিএ।
সেক্ষেত্রে তারা চিঠিতে বলে, সরকারের কাছ বিদ্যুতের দাম যথাসময়ে না পাওয়া, ডলারের সংকট ও আমদানি দায় বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে রয়েছে।
তারপরও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে তাদের নিয়মিত সরকারকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে বিধায় তারা এমন দণ্ড সুদ মওকুফের আবেদন করেছে বিআইপিপিএ।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারের কাছে পাওনা ২৩ হাজার কোটি টাকা
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মালিকদের সরকারের কাছে বিদ্যুতের মূল্য বাবদ পাওনা দুই বিলিয়ন ডলারেরও কিছু বেশি। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি এসব সংকট থেকে উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে বিআইপিপিএ চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, "এ খাতের উদ্যোক্তারা দেউলিয়া হওয়ার পথে। তাদের টিকে থাকতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।"
চিঠির বিষয়ে একটি দৈনিক প্রত্রিকাকে বিআইপিপিএর সভাপতি ফয়সাল খান বলেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বিল জমা দেওয়ার এক মাসের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বিল পেয়েছে। বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে সাত মাসেরও বকেয়া রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসেই বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, পিডিবি পাওনা পরিশোধের সময় ডলারের বিনিময় হার ধরছে ১১১ টাকা। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানির জন্য এলসি খুলতে গেলে ব্যাংকগুলো ডলারের দর চাইছে ১২০ টাকার বেশি।
তিনি বলেন, জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ আমদানিনির্ভর হওয়ায় ডলারের দামে পার্থক্য বিদ্যমান থাকলে বেসরকারি বিদ্যুৎ শিল্প টিকে থাকবে না। তাই এ বিষয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
বিপিডিবির লোকসান ও ভর্তুকি
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটি ২০১২-১৩ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে লোকসান গুনেছে ৫২ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।
আর ২০২২-২৩ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান দাঁড়িয়েছে (সাময়িক হিসাবে) ৫১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই আট বছরের প্রায় কাছাকাছি লোকসান দাঁড়িয়েছে বিপিডিবির।