শেয়ারদরে সর্বনিম্ন মূল্যসীমার কারণে গভীরতর হচ্ছে আইসিবির নগদ অর্থ সংকট
পুঁজিবাজারের মন্দাভাব ও ফ্লোর প্রাইসে কারণে গভীর আর্থিক সংকটে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক-বহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজারে অন্যতম বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী– ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতেই বড় ধাক্কা খেয়েছে আইসিবি। এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ২৩৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি এত বড় লোকসান আগে করেনি।
আইসিবিরি মূলধনি আয়ে (ক্যাপিটাল গেইন) উল্লেখযোগ্য পতনের ফলেই আর্থিক এ সংকট, যা মূলত হচ্ছে ফ্লোর প্রাইসের কারণে ১৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করতে না পারায়। ফ্লোর প্রাইস হচ্ছে- শেয়ার বিক্রয়মূল্যের সর্বনিম্ন সীমা, যার চেয়ে কম দরে শেয়ার বিক্রি করা যায় না।
বিভিন্ন নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ডিপোজিট হিসাবে রাখা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ আটকে থাকার ঘটনায় ইতোমধ্যেই আর্থিক সংকটে রয়েছে আইসিবি, এসব তহবিল অচিরেই ফেরত পাওয়ার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
এসব প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে, গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না আইসিবি, পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে গ্রাহকের ফিক্সড ডিপোজিটের (স্থায়ী আমানতের) মেয়াদ শেষ হলেও টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
বিনিয়োগ কর্পোরেশনটি– সরকারি সংস্থা, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি গ্রাহকের থেকে আমানত নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে। শেয়ারে বিনিয়োগের মাধ্যমে করা আয় থেকে পর্যায়ক্রমে গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধ করে।
আইসিবির কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন তহবিল দিয়ে কিংবা ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় করে পুঁজিবাজার গতিশীল না হওয়া পর্যন্ত, পরিস্থিতির উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তাঁরা।
আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ার বিক্রি করতে পারছি না। বাজারে ক্রেতা নেই। শেয়ার বিক্রি করতে না পারায় ক্যাপিটাল গেইন কম, যার ফলে উল্লেখযোগ্য লোকসান হয়েছে।"
তিনি বলেন, "ক্যাপিটাল গেইন কম থাকায় গ্রাহকের টাকা দিতে পারছি না। আপাতত সুদ পরিশোধ করে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। আশা করি, ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে এই সমস্যা থাকবে না।"
ক্রেতা পাওয়া মাত্রই শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে জানিয়ে আইসিবির এমডি আরও বলেন, "গত কয়েক সপ্তাহে (পুঁজিবাজারে) তালিকাভুক্ত অনেক ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। ওইসব ব্যাংকের মোট শেয়ারের প্রায় ৫-১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার ছিল আইসিবির হাতে। টাকার প্রয়োজন হওয়ায় ব্লক মার্কেটে বিক্রি করা হয়েছে।"
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বড় লোকসান
কর্পোরেশনটির আর্থিক প্রতিবেদন– তাঁদের ক্যাপিটাল গেইন বা মূলধনি আয় ব্যাপকভাবে কমার ইঙ্গিত দেয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে যা ৯০ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকায় নেমেছে। গত অর্থবছরের একইসময়ে মূলধনি আয় ছিল ১৫৭ কোটি টাকা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে আইসিবির মুনাফা ৪৯ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৭৭ কোটি টাকায়, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১৪৪ কোটি টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ১১৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
পাশাপাশি এই সময়ে ডিভিডেন্ড ও ফি, কমিশন ও সার্ভিস চার্জ থেকেও প্রাতিষ্ঠানটির আয় ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে।
নগদ টাকার সংকটের বিষয়ে আবুল হোসেন বলেন, গত কয়েক বছরে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এনে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে আইসিবি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া এখন অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, নতুন তহবিল পেলে পরিশোধে কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠানের তহবিল (আগে) এনেছি, তারা এখন ফেরত চাচ্ছে।
নির্বাচনের পর শেয়ারের বিক্রয় মূল্যসীমা উঠিয়ে নেওয়া হলে অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বিসিক- এর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি
আইসিবির কাছে ক্ষুদ্র, ও কুটির শিল্প নিয়ে কাজ করা বিসিক- এর পাওনা ৮৯ কোটি টাকা। বিসিক তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও সরকারি ঋণের টাকা ফিক্সড ডিপেজিট হিসাবে আইসিবিতে জমা রাখে। মোট ১৭টি এফডিআরের মাধ্যমে এই টাকা জমা রাখা হয়।
ধাপে ধাপে রাখা এসব আমানতের মেয়াদ চলতি বছরের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে শেষ হয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার টাকা নগদায়ন করতে আনুষ্ঠানিকভাবে আইসিবিকে চিঠি দেয় বিসিক।
টাকা না পাওয়ায় নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আবারও একটি চিঠি আইসিবিসহ অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে বিসিক। ওই চিঠিতে জরুরী ভিত্তিতে বিসিক প্রধান কার্যালয়ের নামে পে-অর্ডারের মাধ্যমে প্রেরণের তাগিদ দেওয়া হয় আইসিবি'কে। নাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বিসিক।
আইসিবির এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, অর্থ পরিশোধের জন্য শুধুমাত্র সুদ পরিশোধ করে মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়। তবে চুক্তি নবায়ন করতে চাইছে না বিসিক। যার ফলে বর্তমান অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
এর আগে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড এর সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দিতে পারেনি আইসিবি।
এবছরের এপ্রিলে আইসিবিতে রাখা ৮৪ কোটি টাকা মেয়াদি আমানতের মেয়াদ শেষে নগদায়নের অনুরোধ করে গ্যাস কোম্পানিটি। কিন্তু, আইসিবি দিতে পেরেছে মাত্র ৬৭.৬৯ কোটি টাকা। বাকি টাকা ফেরত পেতে কয়েক দফা চিঠি পাঠানোর পরও কোন কাজ না হওয়ায়, গ্যাস কোম্পানিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চায়।
এবিষয়ে গত মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি চিঠির জবাবে আইসিবি জানায়, পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রি করার জন্য পর্যাপ্ত ক্রেতা ছিল না এবং আর্থিক বাজার স্থিতিশীল হলে তারা বকেয়া পরিশোধ করবে।
চলতি বছরের ২৩ মার্চ পাঠানো চিঠিতে আইসিবি, ক্রেতার অভাবের জন্য বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মন্দাকে দায়ী করেছে। পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির আমানত ফেরত দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি চিঠির জবাবে গত ফেব্রুয়ারিতে আইসিবি একই কথা বলেছিল।
মেয়াদপূর্তির পরেও ১০টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) আইসিবির ৬৬৮ কোটি টাকা আমানত এবং ১০০ কোটি টাকা সুদ আটকে রয়েছে আইসিবির।
এবিষয়ে ২০২২ সালের ২৮ নভেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল টিবিএস।
প্রায় এক বছর পরে এসব টাকা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিবির এমডি আবুল হোসেন বলেন, "এসব তহবিল ফেরত পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা নিচ্ছি। প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নিয়মিত মিটিং হচ্ছে।"