টাকার দুর্বল বিনিময় মান যেভাবে বিদেশি ঋণ পরিশোধের ব্যয় বাড়াচ্ছে
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-র মতে, টাকার মান দুর্বল হওয়ায় চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে বাজেট বরাদ্দের চেয়ে সরকারের ব্যয় প্রায় ১১ শতাংশ বাড়বে।
ইআরডির বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটির সাম্প্রতিক এক সভায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে অতিরিক্ত ৪ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে জানানো হয়। টাকার মানের অবনমনকে এজন্য প্রধান কারণ বলা হয়েছে।
অতিরিক্ত এই অর্থ যোগ করলে, এই অর্থবছরে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের অংক দাঁড়াচ্ছে ৪১ হাজার ৯৬ কোটি টাকায়, অর্থাৎ আগের অর্থবছরের চেয়ে বাড়বে ৫২ শতাংশ।
এরমধ্যে সুদ পরিশোধ করা হবে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, বাকিটা বরাদ্দ থাকবে আসল পরিশোধে। আগের অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ২৬ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
ইআরডির একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, অর্থবছরের শেষের দিকে প্রতি ডলার কিনতে ১১৫ টাকা লাগতে পারে এমন ধারণার ভিত্তিতে সংশোধিত বাজেটে অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, চলতি বছরের বাজেটে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ডলারের বিনিময় দর ১০৪ টাকা ধরে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। কিন্তু, বর্তমানে বিদেশি ঋণ পরিশোধে সরকারের প্রতি ডলারে প্রায় ১১০ টাকা ব্যয় হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতেই এক ডলারের বিনিময় দর ছিল ৮৬ টাকা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাড়তে থাকে এই দর। বর্তমানে যা ২৮ শতাংশ বেড়ে, ১১০ টাকায় পৌঁছেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, টাকার মান কমার ফলেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের খরচ বাড়ছে। তাছাড়া, বৈশ্বিক নানান কারণে বাজার-ভিত্তিক ঋণের সুদহারও বাড়ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, 'বিদেশি ঋণ পরিশোধে যে ব্যয় বাড়ছে, তার বড় অংশই বিনিময় হারের এডজাস্টমেন্ট করতে হচ্ছে বলে। এটা এড়ানো সম্ভব নয়, আবার এ কারণে খুব উদ্বিগ্ন হওয়ারও কারণ নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে।'
ব্যাখ্যা দিয়ে বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধে ডলারের প্রয়োজন রয়েছে, সমস্যাটা সেখানে। কারণ, ডলার কিনতে টাকার দরকার; কিন্তু সরকারের রাজস্ব আহরণে সীমাবদ্ধতার কারণে এই কাজটিও চ্যালেঞ্জিং। ঋণ পরিশোধের চাপ সামাল দিতে সরকারকে এ দুই ফ্রন্টেই যুদ্ধ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আগামীতে সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি– বৈধপথে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের প্রত্যাবাসন বাড়িয়ে ডলার আয় বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যমতে, গেল অক্টোবরে রাজস্ব আদায় হয় ২৭ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, তবে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩১ হাজার কোটি টাকা।
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের প্রদেয় বার্ষিক ফি ও শেয়ারে বিনিয়োগসহ হিসাব করলে দেনার বোঝা আরও বাড়বে।
বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা না গেলে– সামস্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচক, বিশেষ করে- বিদেশি লেনদেনের হিসাবে ভারসাম্য ঠিক করা যাবে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রতি বছরই বিদেশি ঋণ পরিশোধে বাজেট বরাদ্দ পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।'
লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম রাজস্ব আদায়ের মধ্যে মুদ্রার বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা কীভাবে সরকারের আর্থিক সক্ষমতার ক্ষয় করছে বেসরকারি খাতের পর– সরকারের বৈদেশিক ঋণের পরিস্থিতিও তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।
আহসান এইচ মনসুর এবিষয়ে বলেন, টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বেসরকারি খাতের দেনা ব্যাপকভাবে বেড়ে প্রায় এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
এ অবস্থায় তিনিও বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন। একইসঙ্গে, সমস্ত বৈদেশিক আয় প্রত্যাবাসন ও যথাযথভাবে আমদানি ব্যয় ব্যবস্থাপনা করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
ঋণের সুদ ও আসল
ইআরডির সভায় বলা হয়েছে, বিদেশি ঋনের আসল পরিশোধে সংশোধিত বাজেটে অতিরিক্ত ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। মূল বাজেটের ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দের চেয়ে যা ৬.৪৬ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে সুদ-বাবদ অতিরিক্ত ২ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। যা মূল বাজেটের ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দের চেয়ে ১৯.৫৯ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরে ঋণের আসল পরিশোধে ব্যয় হয়েছিল ১৭ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা।
২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারের মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৫৫.৬০২ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের শুরুতে যা ছিল ৬২.৫৭ বিলিয়ন ডলার।