কলমানি রেট বেড়ে ৯.১৩ শতাংশ, এগারো বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গড় কলমানি রেট—যে সুদহারে এক ব্যাংক একদিনের জন্য অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নেয়—গতকাল ৯.১৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বুধবার (২০ ডিসেম্বর) ব্যাংকগুলো কলমানি বাজার থেকে ৩ হাজার ১৮৭.৪২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার গড় সুদহার ৯.১৩ শতাংশ। ২০১৩ সালের পর থেকে কলমানি বাজারে এত চড়া সুদহার কখনও হয়নি। এর আগে ২০১২ সালের পুরো বছরের কলমানির গড় সুদহার ছিল ১২.৮২ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সুদহার বাড়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের পর্যাপ্ত আমানত পাচ্ছে না। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর ব্যাপক নগদ তারল্য ডলার কিনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। যার কারণেও কলমানি মার্কেটে সুদ রেট বাড়ছে।
কিন্তু ব্যাংকগুলোকে আমানতের বিপরীতে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) সংরক্ষণ করতে হয়। এতে বাধ্য হয়েই তারা বেশি সুদে ধার করছে।
ব্যাংকগুলো দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে একে অন্যের কাছ থেকে একদিনের জন্য টাকা ধার নেয়। একে কলমানি বাজার বলা হয়। ব্যাংক যখন টাকার সংকটে পড়ে, অর্থাৎ তারল্য সংকট যখন বাড়ে, তখন এর সুদহারও বেড়ে যায়। আবার তারল্য সংকট কমে এলে এর সুদহার কমে যায়। ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে কলমানি বাজার চালু হয়।
কলমানি রেট কেন বাড়ছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জুনে গড় কলমানি রেট ছিল ৬.০৫ শতাংশ, জুলাইয়ে তা কিছুটা বেড়ে ৬.৪২ শতাংশে দাঁড়ায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল নীতি সুদহার বা পলিসি রেট বাড়ানোর একদিন পর অক্টোবরে এই কলমানি রেট বেড়ে ৭.২৩ শতাংশ হয়ে যায়। ডিসেম্বরের শুরুতে কলমানি রেট ৮.৫৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকে।
মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বছর পলিসি রেট বা রেপো রেট—যে সুদহারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুগুলোকে ধার দেয়—কয়েক দফায় বাড়িয়েছে। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর ফান্ড কস্ট বেড়ে যাওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে কলমানি বাজারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ পলিসি রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭.৭৫ শতাংশ করেছে। এ নিয়ে দুই মাসেরও কম সময়ে পলিসি রেট ১২৫ বেসিস পয়েন্ট বেড়েছে।
কয়েকটি ব্যাংকের মানি মার্কেট হেড কর্মকর্তারা বলেন, ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ ঋণ বিতরণ হয় চলতি মূলধন হিসেবে। কিন্তু ব্যবসার মন্দা পরিস্থিতি থাকায় অনেক গ্রাহক নির্ধারিত সময়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে ডিমান্ড লোনকে মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর অর্থপ্রবাহ কমে আসায় মানি মার্কেট থেকে তারল্য সংগ্রহ করছে।
তারা বলেন, ব্যাংকগুলোর আমনতের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক ধীর। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ব্যাংকগুলো ডলার কিনতে গিয়ে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। তার আগের অর্থবছরে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনায় চলে যায়। এতে গত এক বছর ধরের বেশি সময় ধরে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটে রয়েছে।
কলমানি রেট বৃদ্ধির প্রভাব
কলমানি বাজারে সুদহার বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলোর লাভ কমে যায়। কারণ কলমানি রেট বাড়লে ব্যাংকগুলোর কস্ট অভ ফান্ড বেড়ে যায়। অন্যদিকে ভোক্তা ঋণের সুদহার নির্ধারিত থাকায় ব্যাংকগুলো তারচেয়ে বেশি সুদহার নিতে পারে না।
অগ্রণী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, কলমানি রেট বাড়লে ট্রেজারি-বিল বন্ডের রেট বাড়ার সম্ভাবনাও দেখা দেয়। আর ট্রেজারি বিল-বন্ডের রেট বাড়লে ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহারও বাড়বে।
গত জুলাই থেকে ট্রেজারি বিলের ওপর নির্ভর করে ব্যাংকঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে বলা হয় স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অভ ট্রেজারি বিল। এখন স্মার্টের সঙ্গে ৩.৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করতে পারে ব্যাংকগুলো। জুনে ট্রেজারি বিল বন্ডের গড় রেট ছিল ৭.১০ শতাংশ। নভেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৭২ শতাংশ।
এর আগে কলমানি রেটের রেকর্ড
দেশে কলমানি বাজারে সবচেয়ে বেশি রেট উঠেছিল ২০১০ ডিসেম্বরে। ওই বছরের ডিসেম্বরে গড় কলমানি রেট দাড়ায় ৩৩.৫৪ শতাংশ—যার আগে নভেম্বর মাসে এই রেট ছিল ১১.৩৮ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১০ সালের ডিসেম্বরে সরকার স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) বা বিধিবদ্ধ জমা অনুপাত এবং নগদ জমা সংরক্ষণ বা ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) বাড়িয়ে ১৯ শতাংশ করে। এর ফলে মার্কেটে অনেক ব্যাংকের নগদ তারল্য প্রয়োজন হওয়ায় কলমানি মার্কেট রেট হুট করে বেড়ে যায়।
এমন ধারা ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। ওই সময় রেট ১২.৮২ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল। তবে পরের বছর থেকে কলমানি রেট ৭ শতাংশের নিচে নেমে আসে।