রিজার্ভ পতনের মধ্যে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এফডিআই কমেছে ৪০ শতাংশ
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তিন মাসে বাংলাদেশে নিট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ, যা দেশের রিজার্ভের ক্ষয়কে আরও তরান্বিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুলাই–সেপ্টেম্বর সময়ে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ৬৭০ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল ১.১ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া ২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে দেশে নিট এফডিআই এসেছে ২.১১৫ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৩.৭৮ শতাংশ কম।
দেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আসে। তার থেকে বিনিয়োগকারীদের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন করে বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগ থেকে মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অঙ্ককে নিট এফডিআই বলা হয়।
ব্যাংকাররা বলছেন, যতদিন দেশের অর্থনীতিতে দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব, শ্রম উৎপাদনশীলতা কম এবং অনুন্নত অর্থ ও পুঁজিবাজার থাকবে, ততদিন বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ কম থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
তারা আরও বলেন, দেশের বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ কমে যাওয়া গ্রস অর্থের প্রবাহ কমে আসার লক্ষণ। ব্যাংকাররা বলছেন, এর অর্থ হচ্ছে বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের চেয়ে অন্য জায়গায় বিনিয়োগে বেশি রিটার্ন পাচ্ছে।
জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কোনো বিদেশি উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করার আগে অনেককিছু চিন্তা-ভাবনা করে। 'বিশেষ করে আমাদের দেশের ঋণের রেটিং কমিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি। তাছাড়া দেশে সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে, বিশেষ করে আর্থিক খাতে। এ কারণেই বিদেশি বিনিয়োগ কমছে।'
তিনি আরও বলেন, কোনো বিদেশি উদ্যোক্তা যখন বিনিয়োগ করতে চায়, তখন কর্পোরেট করের ওপর তারা আলাদা গুরুত্ব দিয়ে থাকে। 'বাংলাদেশে জমি ও স্বল্প মূল্যে শ্রমিক পাওয়া যায়, কিন্তু জ্বালানি সংকট এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদনের জটিলতা রয়েছে। এ কারণেই হয়তো বিদেশে উদ্যোক্তারা এখন এদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে না।'
পুনরায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসতে হলে সরকারকে বিনিয়োগবান্ধব দেশ গড়ে তুলতে হবে বলে মন্তব্য করেন এই ব্যাংকার।
আন্তঃকোম্পানি ঋণ কমেছে ১৬২ শতাংশ
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর এফডিআইয়ের অন্যতম উপাদান আন্তঃকোম্পানি ঋণ কমেছে ১৬২ শতাংশ। এই সময়ে নিট আন্তঃকোম্পানি ঋণ ছিল ঋণাত্মক ৫৯ মিলিয়ন ডলার। আগের বছরের একই সময়ে আন্তঃকোম্পানি ঋণ ছিল ধনাত্মক ৯৫ শতাংশ।
বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান যখন মূল কোম্পানি (প্যারেন্ট) থেকে পরিচালন, বিনিয়োগ বা অর্থপ্রবাহ ওঠানামা ব্যবস্থাপনার জন্য ঋণ নেয়, সেটিকে আন্তঃকোম্পানি ঋণ বলা হয়ে থাকে।
রূপালী ব্যাংকের সিএফও শওকত জাহান খান টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশে ডলার সংকটের কারণে স্থানীয় কোম্পানিগুলো তাদের মূল কোম্পানি থেকে গত দুই বছর ধরে ঋণ নিতে পারছে না। তবে তারা আগে যে ঋণ নিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করায় ঋণ আসার চেয়ে বেরিয়ে গেছে বেশি।
গত এক বছরে বাংলাদেশে ডলারের ক্রমবর্ধমান দামের কারণে যেসব কোম্পানি আগে ডলারপ্রতি ৮৫ টাকা ঋণ নিয়েছিল তারা বড় আর্থিক সমস্যায় পড়েছে। তাদের এখন ১১০ টাকায় ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে, যার ফলে ব্যবসায় ব্যাপক লোকসান হয়েছে। ফলে আন্তঃকোম্পানি ঋণ কমেছে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট এফডিআই ২০ বিলিয়ন ডলার
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট এফডিআইয়ের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এ সময় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ ছিল টেক্সটাইল এবং পোশাক, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং এবং টেলিযোগাযোগ খাতে। শীর্ষ বিনিয়োগকারী দেশগুলো ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, হংকং ও চীন।
দেশে গত দুই বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক না বাড়ায় ডলারের সংকট কাটছে না। এরই মধ্যে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ ও বিদেশি বিনিয়োগ ব্যাপক পরিমাণে কমে যাওয়ায় দেশের অন্যতম সূচক ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ঘাটতি বেড়েই যাচ্ছে।
ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি মেটাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
২০২৪ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০.০৩ বিলিয়ন ডলার। এক বছর আগে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২.৪৮ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ঘাটতি ছিল ঋণাত্মক ৫.৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ধনাত্মক ১.২৬ বিলিয়ন ডলার।
এরই মধ্যে দেশের গ্রস এফডিআই কমেছে ১৪.৫০ শতাংশ, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কমেছে ২০.৭০ শতাংশ এবং ফরেন ট্রেড ক্রেডিট ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৩৭ বিলিয়ন ডলার।