শুল্ক কমানোর পর উল্টো দাম বেড়েছে রমজানের ভোগ্যপণ্যের!
রোজার আগে বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে চাল, চিনি, তেলসহ কিছু পণ্যের শুল্ক-কর কমিয়েছে সরকার। কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাব তো পড়েইনি, উল্টো গত এক সপ্তাহে রমজানসংশ্লিষ্ট কয়েকটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ যথাযথ নয়। ডলার সংকটে সাধারণ ব্যবসায়ীরা এতদিন ভোগ্যপণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারেনি। তখন সরকার নজর দেয়নি। ফলে রমজানের এসব ভোগ্যপণ্য আমদানির সুযোগ নিয়েছেন সীমিত কয়েকজন আমদানিকারক।
রমজানের আগমুহূর্তে আমদানিতে শুল্ক-কর কমানোর অর্থ অনেকটা বড় আমদানিকারকদের বাড়তি সুবিধা দেয়ার মতো বলে মন্তব্য করেন ব্যবসায়ীরা।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি চালের আমদানি শুল্ক-কর ৬৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। আর সম্পূরক শুল্ক কমানো হয় ২০ শতাংশ। এছাড়া পরিশোধিত-অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
চিনি আমদানিতে প্রতি টনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১ হাজার টাকা করা হয়েছে, আগে যা ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। আর খেজুর আমদানিতে শুল্ক ৫৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
কিন্তু দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গেছে।
পাইকারি পর্য়ায়ে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৪ টাকা দরে, যা এক সপ্তাহ আগে ১৩২ টাকায় বিক্রি হতো। এছাড়া গত সপ্তাহে পাইকারিতে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৬১ টাকা, পাম তেল ১৩১ টাকা ও সুপার পাম তেল ১৩৪ টাকা দরে বিক্রি হলেও এখন সয়াবিন তেল ১৫৫ টাকা, পাম তেল ১৩৪ টাকা ও সুপার পাম তেল ১৩৭ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এ জামান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী নুরুল আলম বলেন, 'ডলার সংকটের কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীরা আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারেননি। ব্যাংকমালিক কিংবা কোনো না কোনোভাবে ব্যাংকের সাথে সম্পৃক্ত আমদানিকারকরাই প্রভাব খাটিয়ে পণ্য আমদানির সুযোগ পেয়েছেন। রমজানসংশ্লিষ্ট পণ্যসহ দেশের পুরো ভোগ্যপণ্যের বাজার এখন সর্বোচ্চ ১০-১৫ জন বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের হাতে সীমাবদ্ধ। ফলে রমজানের আগমুহূর্তে শুল্ক-কর কমিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। বরং এটা আমদানিকারকদের বাকি পণ্য আমদানিতে শুল্কছাড়ের সুযোগ করা দেয়া। যার কোনো সুফল ভোক্তারা পাবে না।'
কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, 'সাধারণ ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খুলতে পারছেন না—বিষয়টা গত কয়েক মাস ধরে শুনে আসছি। তা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টরা কার্য়কর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
'রমজানের আগমুহূর্তে এখন পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের তোড়জোড় শুরু করেছে সরকার। আমদানি থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্য়ন্ত পূর্ণ প্রতিযোগিতা না থাকলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।'
শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর কল্যাণপুর ও কারওয়ান বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুল্ক কমানোর পরও খুচরা পর্যায়ে ওই ভোগ্যপণ্যগুলোর দাম কমেনি।
কারওয়ান বাজারের ইয়াসিন জেনারেল স্টোরের বিক্রয়কর্মী আলী হোসেন বলেন, খোলা চিনি ১৪০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১৪৫ টাকা কেজি, ছোলা ১১০ টাকা কেজি, বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭০ টাকা লিটার বিক্রি করছেন তারা।
বেড়েছে ছোলার দামও
ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক সপ্তাহে অস্বাভাবিক বেড়েছে রমজানের অন্যতম ভোগ্যপণ্য ছোলার দাম।
তারা বলেন, এক সপ্তাহ আগে পাইকারিতে ভালো মানের প্রতিকেজি ছোলা (অস্ট্রেলিয়া) বিক্রি হয়েছে ৮৭ টাকা। দাম ১০ টাকা বেড়ে সপ্তাহ শেষে বৃহস্পতিবার একই ছোলা ৯৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের যেসব ছোলা ৮০ টাকায় বিক্রি হতো, তার দাম এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১ টাকায়।
একইভাবে স্বাভাবিক সময়ে ৪৫ টাকায় বিক্রি হওয়া সাদা মটরের দাম ঠেকেছে এখন ৬৬ টাকায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, এবারে রমজানকে ঘিরে ছোলা আমদানি হয়েছে চাহিদার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। এই সুযোগে আমদানিকারকদের কাছ থেকে বেশিরভাগ ছোলা খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ী (পায়েল ট্রেডার্স) কিনে নিয়েছেন। ওই ব্যবসায়ী এখন ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন।
তবে বিষয়টি অস্বীকার করে পায়েল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী পরিতোষ মহাজন বলেন, 'বাজারের বেশিরভাগ ছোলা-মটর আমরা মজুদ করেছি, বিষয়টি সত্য নয়। আমরা ১০০-২০০ টন করে পণ্য কিনে বাজারে বিক্রি করি।' তিনি বেশ কয়েকটি বড় কর্পোরেট গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বেশিরভাগ পণ্য রয়েছে।
রমজানে নিরবচ্ছিন্ন পণ্য সরবরাহের আশ্বাস বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, 'বাজারে একচেটিয়া প্রভাব রোধে আমরা ব্যবস্থা নেব।'
গতকাল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি ব্যবসায়ীদের প্রতি রমজানে জনসাধারণকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
চলতি সপ্তাহে আমদানিকারক ও পণ্য উৎপাদনকারীদের সঙ্গে বৈঠক করে তেলের দাম নির্ধারণ করা হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
এছাড়া ভারত পেঁয়াজ ও চিনি সরবরাহ করতে রাজি হয়েছে বলে জানান তিনি। 'আমরা ভারত ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করব।'
তিনি আরও বলেন, পর্যাপ্ত চাল সরবরাহ রয়েছে, মজুদ রয়েছে ১৭ লাখ টনেরও বেশি। 'আমরা অসাধু ব্যবসায়ীদের তৈরি কৃত্রিম খাদ্য সংকট বা মূল্যবৃদ্ধি সহ্য করব না,' বলেন তিনি।