ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাব যেভাবে পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বেশকিছু লক্ষণ দেখা গেছে; বিশেষ করে রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্সের প্রবাহের কল্যাণে। বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের অস্থিরতাও দেড় বছর পর কমতে শুরু করেছে। তবে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব একটি নতুন উদ্বেগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি দেশের চলমান অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য হুমকি তৈরি করেছে।
যদি এ সংঘর্ষ বাড়ে বা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর বিভিন্ন প্রভাব পড়তে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতিবিদেরা।
এ ধরনের একটি প্রভাব হতে পারে জ্বালানি বাজারের অস্থিতিশীলতা এবং তার দরুন জ্বালানির দামে অস্থিরতা — অনেকটা ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে যেমনটা ঘটেছিল তার মতো পরিস্থিতি। এর ফলে মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের তেল ও এলএনজি আমদানি বিলের দায় আরও বাড়তে পারে।
সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হামলায় ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত লোহিত সাগরের শিপিং রুট বাড়তি বাধার সম্মুখীন হতে পারে। বিশেষ করে হরমুজ প্রণালিতে আরও জটিলতা দেখা দিলে চলমান পরিস্থিতি বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। এ নৌপথটি দিয়ে প্রতিদিন বৈশ্বিক তেল উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশ পরিবাহিত হয়। এর ফলে পণ্য পরিবহনের খরচ ও শিপিংয়ের সময় বেড়ে যেতে পারে।
'সংঘাত আরও ছড়ানোর অর্থ হলো আমাদের এবং অন্য অনেকের জন্য পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যাওয়া,' বলেন তেল ও গ্যাস থেকে শুরু করে সমুদ্রগামী জাহাজ, ব্যাংকিং এবং অর্থায়ন ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে নিয়োজিত ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে. চৌধুরী।
তিনি বলেন, তেলের দাম ইতোমধ্যেই প্রতি ব্যারেল ১ ডলার বেড়েছে এবং ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত থাকলে তা আরও বাড়তে পারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) অটোমেটেড মাসিক দামের ফর্মুলা চালুর পর থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে। তবে দাম আরও বাড়লে এ মুনাফা টিকিয়ে রাখা যাবে না। ফলে লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ আরও তীব্র হবে।
বেসরকারি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের সিইও ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল হলে তা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং আমদানি বিল বাড়ানোর দিকে ঠেলে দিতে পারে। সরকার বেশি দামে জ্বালানি আমদানিতে ব্যর্থ হলে লোডশেডিং ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, লোহিত সাগরের নৌপথের পরিবর্তে ইতোমধ্যেই আফ্রিকার মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল করছে। যদি হরমুজ প্রণালি দিয়ে বাণিজ্য ব্যাহত হয় তাহলে শিপিং সময় এবং খরচ আরও বাড়বে। আফ্রিকান অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের কারণে এ পরিস্থিতি জাহাজগুলোর জন্য সম্ভাব্য সংকট তৈরি করতে পারে।
ইরান বা ইসরায়েল কেউই বাংলাদেশ থেকে সরাসরি অভিবাসী শ্রমিক নেয় না। তবে সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়া অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অনুভূত হবে, বিশেষ করে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ দুই দেশে কয়েক হাজার বাংলাদেশি কর্মরত। মাসরুর বলেন, এসব দেশে পর্যটন ও অন্যান্য সেবা খাতে যুদ্ধের ধাক্কা অনিবার্যভাবে সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের জীবিকাকে প্রভাবিত করবে।
'স্বল্পমেয়াদে প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের বর্তমান চাকরি হয়তো হারাবেন না, তবে নতুন কর্মী নেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ হ্রাস পাবে, যা লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে,' তিনি বলেন।
মাসরুর বলেন, যদি এ সংঘাত এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে চলে, তাহলে বাংলাদেশিরা তাদের চাকরি হারাতে শুরু করতে পারেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান অন্যদের মতোই জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং সমুদ্রপথে বাণিজ্যব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, সংঘাত বাড়লে বৈশ্বিক অর্থনীতি নেতিবাচক পরিণতি ভোগ করবে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে চাহিদা হ্রাস পেতে পারে, যার সুস্পষ্ট প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে বিএএসএফ বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাজ্জাদুল হাসান এত দ্রুত কোনো উপসংহারে পৌঁছাতে চান না। তার মতে পরিস্থিতি কীভাবে মোড় নেয় তার ওপর সম্ভাব্য প্রভাব নির্ভর করবে।
'সাধারণভাবে, শিপিং খাতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো আরও গুরুতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া জ্বালানিব্যয় আকাশচুম্বী হতে পারে,' তিনি বলেন।
তিনি আরও বলেন, তা সত্ত্বেও যেহেতু বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করেন, তাই সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে তাদের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব পড়তে পারে।
ইসরায়েলে ইরানের হামলার পর তেলের দাম
ইরানের বড় পরিসরে তেলের মজুত রয়েছে। ওপেক দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম উৎপাদক এটি। আমেরিকান ব্যবসায়িক নিউজ চ্যানেল সিএনবিসি'র মতে, বিশ্ববাজারে ইরানের তেল সরবরাহ করার সক্ষমতায় কোনো বাধা পড়লে তেলের দাম বাড়তে পারে। হরমুজ প্রণালির সম্ভাব্য বন্ধ এ পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলতে পারে।
সিএনবিসি সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আঞ্চলিক যুদ্ধের নতুন করে আশঙ্কা দেখা দিলে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার বা তারও বেশি ছাড়াতে পারে।
লিপো অয়েল অ্যাসোসিয়েটস-এর প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডি লিপোর বরাত দিয়ে গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, 'ইরানের তেল উৎপাদন বা রপ্তানি সুবিধার ওপর যেকোনো আক্রমণ ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ১০০ ডলারে নিয়ে যেতে পারে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে দাম ১২০ থেকে ১৩০ ডলারে উঠতে পারে।'
এদিকে রয়টার্স সোমবার তেলের দামে ১ শতাংশ হ্রাসের কথা জানিয়েছ। এটি ইসরায়েলে ইরানের ১৪ এপ্রিলের হামলার পরে একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের আশঙ্কায় বাজার নিম্নমুখী হওয়ার ইঙ্গিত।
প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ইরানের ভারী অপরিশোধিত তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ৮৩.৪৮ ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের মাসের তুলনায় ৩.১৪ ডলার বৃদ্ধি।
এছাড়া ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ওপেক-এর গড় তেলের মূল্য ৮৪.২২ ডলারে পৌঁছে যা পূর্ববর্তী মাসের তুলনায় ২.৯৯ ডলার বৃদ্ধি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।