সুদ ব্যয় সংশোধন করে ১১.৬ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি, পরের ৩ অর্থবছরের প্রাক্কলন আরও বেশি
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চলতি অর্থবছরে সুদ পরিশোধের ব্যয় এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ পরিমাণ অর্থ দেশের মোট বাজেট বরাদ্দের এক-সপ্তমাংশের সমান এবং স্বাস্থ্য খাতে বার্ষিক ব্যয়ের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক নথিতে দেখা গেছে, রাজস্ব সংগ্রহের ঘাটতির কারণে গত ছয় বছরে সুদ ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে সরকার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটাতে দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করছে।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ ১১ দশমকি ৫৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। নথি অনুযায়ী বছরের শেষ নাগাদ এর পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয় প্রাক্কলন করেছে, দেশি ও বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় আগামী দুই আর্থিক বছরে ১৫ শতাংশ বা তার বেশি বাড়বে।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় শুরু হওয়া এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এখন সরকারের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উভয় ধরনের ঋণের সুদহার যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আর্থিক চাপকে আরও গুরুতর করেছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশের মধ্যে সীমিত ছিল। সরকারের ট্রেজারি বিলের নিলামের হারও কম ছিল।
তবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত পূরণের জন্য ব্যাংকঋণ ও আমানতের সুদহারের সীমা প্রত্যাহার করার কারণে সুদের হার বাড়ছে।
ফলে সরকার টাকা ধারের জন্য চড়া সুদে ট্রেজারি বিল বিক্রি করছে। এতে আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণে সুদ বাবদ সরকারের ব্যয় আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থ কর্মকর্তারা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকারের সুদ ব্যয়সহ পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির হারের মতো একই হারে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি হওয়া উচিত ছিল।
'কিন্তু তা হয়নি। ফলে আহরিত রাজস্বের বড় অংশ সুদ পরিশোধে চলে যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি ঋণের অর্থায়নে পরিচালিত বড় বড় সরকারি প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে,' তিনি বলেন।
তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগের তুলনায় এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক ও আর্থিক সুবিধা তুলনামূলকভাবে কম। এ প্রকল্পগুলো থেকে প্রত্যাশিত আয় আসছে না। এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কেন সুদ ব্যয় বাড়ছে
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা, যা অর্থবছরের মোট বাজেটের ১২ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
সংশোধনের মাধ্যমে বাজেটের আকার কমানো হলেও অন্যান্য বছরের মতো এবারও সুদ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত ১০ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার সাত লাখ ১১ হাজার ৪১৬ কোটি টাকার মধ্যে সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে এক লাখ পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটের ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।
এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য ৮৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদের জন্য ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রাথমিক বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ৮২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের জন্য ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।
সরকার ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের বড় অংশ সংগ্রহ করে ট্রেজারি বিল বিক্রির মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২১ এপ্রিল সরকার ৯১ দিনের মেয়াদি ট্রেজারি বিলে তিন হাজার ৩৪০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা নিয়েছে। এর সুদহার ছিল ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
একই দিনে ১১ দশমিক ২০ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ সুদে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে ৮১৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে ৪৫৭ কোটি ১০ লাখ টাকা নিয়েছে সরকার।
অর্থ কর্মকর্তারা বলেন, রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ঘাটতির কারণে সরকারকে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে সার ও বিদ্যুতের বকেয়া ভর্তুকিও ধার করে পরিশোধ করতে হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এ দুই খাতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি এখনও বকেয়া রয়েছে বলে জানান তারা।
তাছাড়া অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় হ্রাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমাতে সরকারের ওপর শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল।
ফলে অর্থ মন্ত্রণালয় সঞ্চয়পত্রে সাধারণ মানুষ যাতে বেশি বিনিয়োগ করতে না পারে, সেজন্য নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা। এতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমলেও সরকারের অভ্যন্তরীণ সুদ ব্যয় বেড়েই চলছে।
বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে গত ফেব্রুয়ারিতে অর্থসচিবকে চিঠি দেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী।
চিঠিতে তিনি লেখেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বর্ধিতহারে বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে। এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে বিশেষ উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে বিদেশি ঋণ নেওয়া হচ্ছে।
ফলে ঋণের কিস্তির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে চিঠিতে জানিয়েছেন ইআরডি সচিব।
'বর্তমানে নেওয়া বিদেশি ঋণের প্রায় ৪৫ শতাংশ এসডিআর [স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস] মুদ্রায়। এসব ঋণ পরিশোধ হয় সাধারণত মার্কিন ডলার ও যুক্তরাজ্যের পাউন্ড স্টার্লিং মুদ্রায়। এসডিআর মুদ্রার সঙ্গে ডলার ও পাউন্ডের বিনিময় হার, ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের তারতম্য এবং ইউরোবর/সোফর হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের ওপর সুদ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।
আগামী বাজেটে যা আছে
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নথির পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট-লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আসন্ন অর্থবছরের সুদ পরিশোধের জন্য ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ বাড়তি বরাদ্দ প্রাক্কলন করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সুদ ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ প্রাক্কলন করা হয়েছে এক লাখ আট হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ৯৩ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রাক্কলন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
২০২৫–২৬ অর্থবছরের বরাদ্দ তার আগের অর্থবছরের তুলনায় বাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ওই অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে মোট এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন করেছে।
এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ ১৮ হাজার কোটি টাকা।
২০২৫–২৬ অর্থবছরের তুলনায় তার পরবর্তী অর্থবছরে সুদ পরিশোধ ব্যয়ের জন্য ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রাক্কলন করা হয়েছে।
২০২৬–২৭ অর্থবছরের জন্য ঋণের সুদ ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ও বিদেশি ঋণের সুদ ২২ হাজার কোটি টাকা।
সাম্প্রতিক বাজেটসমূহে সুদ বরাদ্দ
বিগত কয়েকটি বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, সংশোধিত বাজেটের তুলনায় সরকারের ব্যয় কম হয়েছে। তবে বাজেটের আকার হ্রাস পেলেও ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
যেমন ২০২২–২৩ অর্থবছরে প্রাথমিক বাজেটে সুদ প্রদানের জন্য বরাদ্দ ছিল ৭৯ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৮৯ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা করা হলেও সুদ পরিশোধে প্রকৃত ব্যয় ছিল ৯২ হাজার ১০৭ কোটি টাকা।
অর্থাৎ ওই অর্থবছরে ঋণের সুদের প্রকৃত ব্যয় মূল বাজেট বরাদ্দের চেয়ে ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেট বরাদ্দের তুলনায় ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।
আবার প্রতি অর্থবছরে মূল বাজেট, সংশোধিত বাজেট ও প্রকৃত বাজেট ব্যয়ের বিপরীতে সুদ পরিশোধের ব্যয় বাড়তে থাকে।
২০২২–২৩ অর্থবছরে সুদ ব্যয় প্রাথমিক বাজেটের তুলনায় ১৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ, সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং প্রকৃত বাজেটের তুলনায় ১৬ দশমিক ০৫ শতাংশ ছিল।
২০২২–২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে সুদের ব্যয় বরাদ্দের তুলনায় সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ১২ দশমিক ১১ শতাংশ বাড়ে।
একইভাবে ২০২১–২২ অর্থবছরের বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য ৬৮ হাজার ২১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। তবে ঋণের সুদ বাবদ প্রকৃত ব্যয় দাঁড়ায় ৭৭ হাজার ৭৭২ কোটি টাকায়।
অর্থাৎ অর্থবছরটিতে ঋণের সুদ ব্যয় মূল বাজেটের বরাদ্দের তুলনায় ১৪ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৯ দশমিক ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ওই বছর প্রকৃত বাজেট ব্যয়ের তুলনায় সুদ পরিশোধে সরকার ব্যয় হয়েছিল ১৫ শতাংশের বেশি।