ডলার পরিস্থিতির উন্নতি: মার্চে আমদানি এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি বেড়েছে
ব্যাংকখাতে ডলারের তারল্য পরিস্থিতি উন্নত হওয়ায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে মার্চে ইম্পোর্ট লেটার অফ ক্রেডিট বা আমদানি এলসি খোলা এবং সেটেলমেন্ট বা নিষ্পত্তি– উভয়ই বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ও বেসরকারি ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে ব্যাংকগুলো ৬.১৩ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খুলেছে, যা ফেব্রুয়ারির তুলনায় ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি। গত ফেব্রুয়ারিতে খোলা হয়েছিল ৫.২৮ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি।
এদিকে, ২০২৩ সালের মার্চে আমদানি এলসি খোলা হয়েছিল ৬ বিলিয়ন ডলারের কম। গত এক বছরের মধ্যে মাত্র ৩ বার আমদানি এলসি খোলা হয়েছে ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "ডলারের সংকট এখনো কাটেনি। তবে গত কয়েকমাস ধরে প্রতিমাসে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি হচ্ছে। রেমিট্যান্স ইনফ্লোও ভালো। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর হাতে ডলারের তারল্য ভালো। ফলে, আগে যেসব পণ্যের আমদানি এলসি আমরা খুলতাম না, এখন সেগুলোও খোলার চেষ্টা করছি।"
হাতে ডলার থাকায় সাইট এলসি খোলা আগের তুলনায় বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, "গত ২/৩ মাস আগেও আমাদের খোলা এলসির ২৫ শতাংশ ছিল সাইট, বাকিটা ছিল ডেফার্ড। মার্চ মাসে যেসব এলসি খোলা হয়েছে, তার ৫০ শতাংশের বেশি সাইট এলসি।"
সাইট এলসির ক্ষেত্রে অবশ্যই এক সপ্তাহের মধ্যে পেমেন্ট করতে হয়। ব্যাংকগুলোতে যখন ডলারের তারল্য অবস্থা ভালো থাকে, তখন এ ধরনের এলসি খোলা হয়। অন্যদিকে, ডেফার্ড বা বিলম্বিত এলসি পেমেন্টের জন্য ৯০ থেকে ১৮০ দিনের সময় থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো আমদানি লেনদেনের জন্য ডেফার্ড এলসি খুলতেই পছন্দ করে। অন্য কথায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে হওয়া আমদানি লেনদেনের জন্য যেসব এলসি খোলা হয়েছিল, সেগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের অর্থ প্রদান করা হয়েছে মার্চ মাসে।
ব্যবসায়ীরা এখন সাইট এলসি বেশি খুলতে চাচ্ছেন মন্তব্য করে আরেক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সামনের দিনগুলোতে ডলারের দাম কেমন থাকবে, এটি নিশ্চিত হওয়া কঠিন। ডলারের দাম বেড়ে গেলে ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতির শিকার হতে হয়। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা সাইট এলসি খোলায় বেশি আগ্রহী।
এপ্রিলে এলসি খোলার পরিমাণ কমবে মন্তব্য করে এই ব্যাংকার আরও বলেন, "ঈদের কারণে বেশ অনেকদিন ফ্যাক্টরি ও ব্যাংক বন্ধ ছিল। ফলে এপ্রিলে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি– দুটোই কমবে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ভোগ্যপণ্যের আমদানি এলসি খোলা কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। এছাড়া, ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি এলসি খোলা কমেছে ১৯ শতাংশ, মধ্যবর্তী পণ্য কমেছে ১৭ শতাংশ এবং শিল্পের কাঁচামাল কমেছে ৪ শতাংশ।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হুসেইন বলেন, "ডলার পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক স্থিতিশীল হয়েছে। ডলারের দামও কমেছে। ব্যাংকগুলোর হাতে এখন ভালো পরিমাণে ডলার রয়েছে।"
"তবে আমরা দেখছি আমদানি এলসি খোলার চাহিদা কমেছে, এটি স্বাভাবিক। সার্বিক অর্থনীতিতে যে চাপ রয়েছে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণে ভোক্তার চাহিদা সব জায়গায় কমে গেছে। যে কারণে সার্বিক আমদানি এলসি খোলার চাহিদা কমেছে। এছাড়া, ব্যবসায়ীরাও হয়তো ব্যবসা সম্প্রসারণের বিষয়ে এখন একটু চিন্তাভাবনা করছে।"
অর্থনীতি ধীরে ধীরে রিকভার করলে, ভোক্তার চাহিদাও বাড়বে। তবে এতে কিছুটা সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে ১৪.৫ শতাংশ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মার্চ মাসে আমদানি এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৫.৪৫ বিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারির তুলনায় এটি ১৪.৫ শতাংশ বেশি। ফেব্রুয়ারি মাসে নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ।
ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে জানালেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা পর্যাপ্ত এলসি খুলতে পারছেন না। এছাড়া এলসি নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম বেশি দিতে হচ্ছে। এদিকে ব্যাংকগুলো জানিয়েছে, এলসি নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম রাখা হচ্ছে ১১৪ থেকে ১১৫ টাকা।
দেশের ভোগ্যপণ্যের বড় আমদানিকারক সিটি গ্রুপ। এই গ্রুপের কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, "আমরা এখনও চাহিদামতো এলসি খুলতে পারছি না। এছাড়া এলসি খোলার জন্য আমাদের মার্জিন রাখতে হচ্ছে। এতে আমাদের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। এর উপর এলসি নিষ্পত্তিতে ব্যাংকগুলো আমাদের কাছে ১১১৮ থেকে ১১৯ করে রাখছে।"
এসময় তিনি ব্যবসায়ীদের জন্য 'সিঙ্গেল পার্টি বোরোয়ার লিমিট' বাড়ানোর প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো এখন কী পরিমাণ পেমেন্ট ভবিষ্যতে করতে হবে– সেটি আগে থেকেই হিসাব করে রাখছে। সে অনুযায়ী, নতুন এলসি খুলছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে এখন ডেফার্ড এলসি পেমেন্টের চাপ কম।
ডেফার্ড এলসি পেমেন্টের চাপ আগের তুলনায় কমেছে মন্তব্য করে সেলিম আরএফ হুসেইন বলেন, "ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলে আমরা জেনেছি, পরিস্থিতি এখন আগের তুলনায় অনেক ভালো।"