কুলিং সিস্টেম, লিফট, হাই-টেক পার্কে বাড়তে পারে আমদানি শুল্ক
সরকার আগামী বাজেটে এয়ার কুলার ও রেফ্রিজারেটর কম্প্রেসার, চিলার, লিফট, সিসিটিভি ক্যামেরা এবং প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড বিল্ডিং সামগ্রীসহ কমপক্ষে ১৩ ধরনের মেশিনারির আমদানি শুল্ক বর্তমান ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাই-টেক পার্কের বিনিয়োগকারীরা তাদের বর্তমান শুল্কমুক্ত সুবিধা হারিয়ে প্রায় সমস্ত ক্যাটাগরির মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্কের মুখোমুখি হতে পারেন।
পাশাপাশি এ বিনিয়োগকারীদের গাড়ি আমদানির জন্য কাস্টম শুল্ক বাদে বাকি সব শুল্ক দিতে হতে পারে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, আসন্ন বাজেটে সিএনজি কনভার্সন কিট, সিলিন্ডারসহ সংশ্লিষ্ট মেশিনারির আমদানি শুল্ক বাড়ানো হতে পারে। সুইচ এবং সকেট আমদানির জন্য ন্যূনতম ট্যারিফ মূল্য প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়তে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রেফ্রিজারেটর, এয়ার কুলার, চিনিযুক্ত পণ্য ইত্যাদির মতো স্থানীয় শিল্পের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের করহার বাড়িয়ে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আয়কর এবং আমদানি শুল্কের রেয়াত কমানোর কথাও বিবেচনা করছে।
বিশেষজ্ঞ এবং শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি দেশে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে শিল্পায়নের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, 'বাংলাদেশে রাজস্বের প্রয়োজন এবং ছাড়ও কমাতে হবে। তবে গত কয়েক বছর ধরে দেশে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে।'
'এমন সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ১ শতাংশ থেকে এক লাফে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ালে তা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হবে না,' তিনি আরও বলেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, আমদানিতে শূন্য-শুল্ক সুবিধা থেকে বেরোনোর নীতির অংশ হিসেবে কিছু নির্দিষ্ট শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়তে পারে।
এছাড়া এ তালিকা থেকে কিছু মূলধনি যন্ত্রপাতি বাদ দেওয়ার এবং সেগুলোর ওপর বাড়তি হারে শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, স্থানীয় কিছু শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়ানো হতে পারে।
সূত্র জানিয়েছে, আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনায় থাকা বেশিরভাগ মূলধনি যন্ত্রপাতি টেক্সটাইল ও পোশাক কারখানায় ব্যবহৃত হয়।
শিল্প মালিকেরা আগামী অর্থবছরের বাজেটের জন্য এনবিআরের প্রস্তাবিত পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, এ খাতের বিদ্যমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জসমূহের মধ্যে এমন পদক্ষেপ শিল্পায়নের ওপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহ-সভাপতি মো. সালেউদ জামান খান বলেন, 'এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে আমদানিকারকদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, যা বৈশ্বিক বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এটি শিল্পায়নকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।'
তিনি ব্যাখ্যা করেন, 'আমরা অত্যন্ত উন্নত ও ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর নির্ভর করি। যেমন, আমাদের কারখানার তাপমাত্রা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখতে আমাদেরকে চিলার ও এয়ার কন্ডিশনারের জন্য কম্প্রেসার আমদানি করে ব্যবহার করতে হয়।
'আমদানি শুল্ক বাড়ালে অনেক প্রতিষ্ঠান এ ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানি করার আর্থিক সক্ষমতা হারাবে। এতে উৎপাদনশীলতা কমবে।'
সালেউদ জামান বলেন, 'আমাদের প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্রপাতি দেশে উৎপাদন করা হয় না। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শুরু হলে শুল্ক বাড়ানোর কথা বিবেচনা করা যুক্তিসঙ্গত হলেও বর্তমান পরিস্থিতি এ ধরনের [শুল্ক] সমন্বয়ের জন্য উপযুক্ত নয়।'
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, 'স্থানীয় ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে দেশে বর্তমানে বিনিয়োগ ইতোমধ্যে নিম্নমুখী। এমন পরিস্থিতিতে মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক বাড়ালে তাতে বিনিয়োগকারীদের উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে। এতে প্রকারান্তরে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে।'
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, ২০২২–২৩ অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে শিল্প খাতে বিনিয়োগ ১ দশমিক ৭১ শতাংশ কমেছে।
২০২১–২২ অর্থবছরে শিল্পে বিনিয়োগ জিডিপির ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকলেও এটি চলতি অর্থবছরে ৭ শতাংশের নীচে নেমে গেছে।
যেসব যন্ত্রপাতি-পণ্যে আমদানি শুল্ক বাড়বে
বর্তমানে এয়ার কুলার এবং রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসারের আমদানি শুল্ক ১ শতাংশ। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের আসন্ন বাজেটে এটি বেড়ে ১০ শতাংশ হতে পারে।
চিলার, প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড বিল্ডিং সামগ্রী, লিফট এবং ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি বিভাগের আওতায় ব্যবসায়ীদেরকে ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিতে হয়। এ শুল্ক হারও বেড়ে ১০ শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া ওয়াটার পিউরিফায়ারের আমদানি শুল্ক বিদ্যমান ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ হতে পারে।
সুইচ ও সকেট আমদানির জন্য বর্তমান ন্যূনতম শুল্ক মূল্য হলো ছয় ডলার। এটি প্রতি কেজিতে বেড়ে আট ডলার পর্যন্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি সুইচ-সকেটের পার্টসের শুল্ক বর্তমান সাড়ে চার ডলার থেকে কেজিপ্রতি ছয় ডলারে উঠতে পারে।
অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগকারীরা মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্কের সম্মুখীন হতে পারেন। বর্তমানে তারা এক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছেন।
এছাড়া এসব শিল্প এলাকায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত যানবাহন কাস্টম শুল্ক ব্যতীত বাকিসব আমদানি শুল্কের আওতায় আসবে।
বর্তমানে যানবাহন আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক সর্বোচ্চ ৫০০ শতাংশ। এর সঙ্গে অন্যান্য ভ্যাট ও কর মিলিয়ে এটি প্রায় ৮০০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। আর বর্তমানে প্রযোজ্য শুল্ক সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ।
এছাড়াও সিএনজি কনভার্সন কিট, সিলিন্ডার এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। একইসঙ্গে আসন্ন বাজেটে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াকরণের কাঁচামালের আমদানি শুল্ক ১১ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ হতে পারে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি ওয়াটার পিউরিফায়ারের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়, তাহলে তা ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়াতে পারে।
দেশে ওয়াটার পিউরিফায়ার পিউরিট বাজারজাত করা ইউনিলিভার বাংলাদেশের সিইও এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ জাভেদ আখতার বলেন, 'আমদানি শুল্ক বাড়লে তা আমাদের ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। এ বৃদ্ধির পরিমাণ আমাদের এটি অ্যাবজর্ব [নেওয়ার] করার ক্ষমতা এবং ভোক্তার কাছে আমাদের কতটা স্থানান্তর করতে হবে তার ওপর নির্ভর করবে।'