তিতাস গ্যাসের ভুল পদক্ষেপে বন্ধ মুন্সিগঞ্জে শিল্প-কারখানার উৎপাদন
অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার বৈধ গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ এক মাসের বেশি সময় ধরে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
এতে বিপাকে পড়েছে গজারিয়া অঞ্চলের এক ডজনের বেশি ছোট-বড় শিল্প-কারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা, কাগজ, সিমেন্ট, ফিড উৎপাদনকারী, ইলেকট্রনিক্স পণ্য ও কেবল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এমন পরিস্থিতির কথাই জানান, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির সূত্র জানিয়েছে, গজারিয়া অঞ্চলে তাদের সিস্টেম লস কমাতেই এ পদক্ষেপ। কিন্তু এতে বৈধ গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার শ্রমিকের বেতন ও ঈদ বোনাসও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে জানান শিল্পগুলোর কর্মকর্তারা।
এসব প্রতিষ্ঠান বিদেশি ক্রেতার ডেডলাইন অনুযায়ী পণ্যের অর্ডার সরবরাহ ও ঋণ পরিশোধ নিয়েও ব্যাপক প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে।
এনিয়ে গত ৬ জুন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-র সাথে একটি বৈঠকের পরেও কারখানা মালিকরা এখনো তাদের গ্যাস-সংযোগ পাননি। এতে আরো কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
তিতাসের এই ভুল পদক্ষেপের সর্বশেষ শিকার শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক ডেনিম। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত এই প্রতিষ্ঠান গতকাল গজারিয়ায় তাদের কারখানাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে।
প্যাসিফিক ডেনিমের বার্ষিক টার্নওভার প্রায় দেড়শ কোটি টাকা, কর্মসংস্থান করেছে দুই হাজার জনের।
কিন্তু, এক মাসের বেশি সময় ধরে গ্যাস না থাকায় বিদেশি ক্রেতার পণ্যের অর্ডার সরবরাহ ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ নিয়ে জটিলতার মধ্যে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। টিবিএসকে একথা জানান কোম্পানি সচিব মো. সোহরাব আলী।
গত ২৮ এপ্রিল, কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়া মুন্সিগঞ্জের গজারি থেকে দাউদকান্দি ব্রিজ পর্যন্ত এলাকায় মূল লাইনে পুরো গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ঘোষণা করে তিতাস গ্যাস।
এতে গ্যাস পাচ্ছে না বৈধ আবাসিক গ্রাহকরাও।
তিতাস সূত্রগুলো জানায়, গত অর্থবছরে সার্বিকভাবে তিতাসের সিস্টেম লস হয়েছিল ৫.২৮ শতাংশ, তবে গজারিয়া অঞ্চলে এটা ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিতাসের মেঘনাঘাট অঞ্চলের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মুনিরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "অবৈধ গ্রাহকদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে মূল লাইন বন্ধ করা হয়েছে। এখানে বৈধ লাইনের চেয়ে অবৈধ লাইনের সংখ্যা বেশি।"
তিনি বলেন, "এই অঞ্চলে অন্তত বৈধ গ্রাহক ২,৫০০ কিন্তু অবৈধ সংযোগ ১৫ হাজারের বেশি। যারা বৈধ গ্রাহক তাদের সংযোগ ফিরিয়ে দিতে কাজ করছি।"
অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এতদিন সময় প্রয়োজন হয় কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
এবিষয়ে জানতে তিতাসের নারায়ণগঞ্জ আঞ্জলিক বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আনিসুর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
একইভাবে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্'র সাথে যোগাযোগের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।
এমতাবস্থায় গ্যাস-নির্ভর কারখানাগুলো পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ করেলেও দু-একটি প্রতিষ্ঠান বিকল্প পন্থায় বিদ্যুতের মাধ্যমে আংশিক উৎপাদন সচল রাখতে পেরেছে।
গজারিয়া শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত কারখানাগুলো হচ্ছে- সুপার স্টার গ্রুপ লিমিটেড, মেনস ফি পেপার মিলস, আধুনিক পেপার মিলস, পাইওনিয়ার পেপার মিলস, হাসান রাবার লিমিটেড, প্যাসিফিক ডেনিম, এসএস জি পেপার মিলস, নিউ হোপ ফিড কোম্পানি, কাজী ফার্মস, আনোয়ার সিমেন্ট সীট, সুপার স্টার কেবল, পলি কেবল ও মেঘনা গার্মেন্টস।
এরমধ্যে অন্তত ছয়টি কোম্পানির কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানান, ২৮ এপ্রিল থেকে গ্যাস সংযোগ না থাকায় কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। ডেনিম, পেপার বা টিস্যু পণ্য এবং ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার বেশি। কিন্তু একটুও গ্যাস না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে ফ্যাক্টরি বন্ধ করতে হয়েছে। কারণ কবে পুনরায় গ্যাস-সংযোগ মিলবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না।
নিউ হোপ ফিড কোম্পানির সহকারী জেনারেল ম্যানেজার সালাহউদ্দিন সজিব টিবিএসকে বলেন, "গ্যাস না থাকায় বিদ্যুৎ দিয়ে কারখানা আংশিক চালু রয়েছে। আমাদের দৈনিক ৪০০ টন ফিড উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও – এখন উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে মাত্র ২০০ টন। বেশিরভাগ শ্রমিককে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। পূর্ণ সক্ষমতায় কারখানা সচল রাখা না গেলে- বড় সংকটে পড়তে হবে।"
সুপার স্টার গ্রুপের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জিব দেবনাথ বলেন, "আমাদের টিস্যু উৎপাদনের তিনটি কারখানা রয়েছে, সবকটিই বন্ধ রাখা হয়েছে । বিনা নোটিশে গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় তাৎক্ষনিকভাবে ২ কোটি টাকার কাঁচামাল নষ্ট হয়েছে। এখন কারখানা চালু করতে না পারায় ৫-৭ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। দ্রুত গ্যাস সংযোগ না পেলে লোকসান আরও বাড়বে।"
তিনি বলেন, "আমাদের ফ্যান উৎপাদনেরও একটি কারখানা রয়েছে, সেটা পুরোপুরি গ্যাস-নির্ভর। গত ২৮ তারিখ থেকে সেটিও বন্ধ। সবমিলিয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে খুব একটা অস্বস্তির মধ্যে রয়েছি, জানি না কবে এই সমস্যার সমধান হয়।"
আকিজ ভেঞ্চারের প্রতিষ্ঠান আধুনিক পেপার মিলস। রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের পণ্যের মোড়ক হিসাবে কার্টুন তৈরি করে মিলটি। মিলটিতে তিন শতাধিক শ্রমিক রয়েছে। গ্যাস সংযোগ না থাকায় গত ২৮ এপ্রিল থেকে এই কারখানাও বন্ধ।
প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা আল আমিন টিবিএসকে বলেন, "কারখানা বন্ধ, শ্রমিকদের কাজ দিতে পারছি না। তিতাস অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অভিযানের নামে কালক্ষেপণ করছে। যারা অবৈধ, সেসব লাইন দ্রুত বিচ্ছিন্ন করে আমাদের সংযোগ অবিলম্বে সচল করা উচিত। এদিকে আমাদের মেশিনের চাকা ঘুরছে না, কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "গ্রাহকের চাহিদামত পণ্য দিতে না পারায়– তারা অন্য প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের থেকে পণ্য নিচ্ছে, এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের প্রতিষ্ঠান। আবার বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে চাহিদামত কাঁচামাল নিতে না পারায়, তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। এভাবে কারখানা বন্ধ থাকায় সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। "
দ্রুতই গ্যাস সরবরাহের আশ্বাস
গজারিয়া অঞ্চলে অবস্থিত ১৩টি শিল্প-কারখানার প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। সেখানে যত দ্রুত সম্ভব তাদের গ্যাস পুনঃসংযোগের আশ্বাসও দেওয়া হয় তিতাসের পক্ষ থেকে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, "সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই বৈধ গ্রাহকের সংযোগ ফিরিয়ে দিতে হবে। আর যারা অবৈধ লাইন নিয়েছে, নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।"
ওই কর্মকর্তা গতকাল রোববার টিবিএসকে বলেন, তিতাস এমন আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে কবে গ্যাস সংযোগ ফিরবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
প্রসঙ্গত, ১২ মে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য সময়সূচি চেয়ে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেয়। তবে তিতাস সূত্রগুলো জানায়, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।