পরিশোধের চাপ কমাতে জাপানি ইয়েনে ঋণ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ
ক্রমবর্ধমান সুদহার ও অস্থির মার্কিন ডলারের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার পদক্ষেপ হিসেবে সরকার ডলারের পরিবর্তে জাপানি ইয়েনে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে কিছু ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তাদের মতে, বাজারভিত্তিক সুদহারে বিশ্বব্যাংক থেকে স্কেল-আপ উইন্ডো ঋণের জন্য বিশেষ করে ইয়েনে ঋণ নেওয়া হচ্ছে।
তারা বলেছেন, জাপানি মুদ্রায় বিশ্বব্যাংক থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা এবং একটি প্রকল্পের জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ নেওয়া হচ্ছে।
বিতরণের পর ডলার কিনতে জাপানি মুদ্রা ব্যবহার করা হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, কিছু সাময়িক ক্ষতি সত্ত্বেও এটি বাস্তবায়ন ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের চাপ কমিয়ে দেবে। ইআরডি, অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইআরডি কর্মকর্তারা বলেন, ডলারের পরিবর্তে ইয়েনে ঋণ নেওয়া হলে সার্বিক সুদের হার অনেক কম হবে।
তারা বলেন, এটি সুদ পরিশোধে সরকার যে বর্তমান চাপের সম্মুখীন হচ্ছে তা থেকে কিছুটা স্বস্তি দেবে। এছাড়া, যেহেতু জাপানি মুদ্রা ডলারের তুলনায় কম অস্থিতিশীল, তাই ভবিষ্যতে ঋণের মূল পরিমাণ পরিশোধে ঝুঁকি হ্রাস পাবে বলেও মনে করেন তারা।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, ইয়েন-নির্ধারিত ঋণের সুদের হার কম হতে পারে কারণ এটি টোকিও ওভারনাইট এভারেজ রেট (টোনা)-এর ওপর ভিত্তি করা যা সোফর (সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট) বা লাইবর (লন্ডন ইন্টার ব্যাংকে অফার রেট) থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। বিনিময় হারের ওঠানামার কারণে মূল্যায়ন হারানোর ঝুঁকি এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) বা ডলারে ধার নেওয়ার থেকে আলাদা নয়।'
তিনি আরও বলেন, 'স্কেল-আপ উইন্ডো ব্যবহার করে বাংলাদেশ কোর আইডিএ (আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা) থেকে অর্থায়ন নিতে পারে। অবশ্যই স্কেল-আপ উইন্ডো থেকে নেওয়া অর্থের খরচ বেশি। কিন্তু আমরা যদি কোর আইডিএ পুরোপুরি ব্যবহার করি, তাহলে এটিই পরবর্তী সেরা বিকল্প।'
ইআরডি কর্মকর্তারা বলেছেন, ২১ জুন অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা ঋণের একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। এর মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের সমতুল্য পরিমাণ ইয়েনে নেওয়া হবে বলে জানান তারা।
কর্মকর্তারা বলেন, এ ঋণের সুদহার হবে টোনা প্লাস ভেরিয়েবল স্প্রেড, যা বিশ্বব্যাংক প্রতি তিন মাস অন্তর নির্ধারণ করে। চার বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সময়কাল ৩৫ বছর। এছাড়া শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ ফ্রন্ট-এন্ড ফি রাখা হবে। পাশাপাশি, ছাড় না হওয়া তহবিলের জন্য শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ অঙ্গীকার ফিও থাকবে বলে কর্মকর্তারা জানান।
ইআরডি কর্মকর্তাদের মতে, সরকার বাকি ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে বিশ্বব্যাংকের স্কেল-আপ উইন্ডো-শর্টার ম্যাচিউরিটি থেকে। এ ঋণের পরিশোধের মেয়াদ হবে ১২ বছর, যার মধ্যে গ্রেস পিরিয়ড [ঋণ প্রদানের তারিখ থেকে প্রথম কিস্তি আদায়ের মধ্যবর্তী বিরতিকাল] ছয়বছর।
ইয়েন ঋণের সুদ সস্তা
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, ডলারে ঋণ নেওয়া হলে সার্বিক সুদের হার হবে প্রায় ৭ শতাংশ। অন্যদিকে, জাপানি মুদ্রায় নেওয়া ঋণের জন্য বাংলাদেশকে অনেক কম সুদ( প্রায় ২ শতাংশ) দিতে হবে।
যদি ৩০০ মিলিয়ন ডলারে নেওয়া হয়, তাহলে এটি সোফরের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হবে। এর সঙ্গে ভেরিয়েবল স্প্রেড যোগ করা হবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর থেকে সোফর রেট উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এমনকি দুই বছর আগেও সোফর ১ শতাংশের কম ছিল। সোফর বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে চাপের সম্মুখীন হচ্ছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রকাশিত উপাত্ত অনুযায়ী, সরকার চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম ১০ মাসে প্রায় ১.১৫ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা) ব্যয় করেছে সুদ পরিশোধে, যা বার্ষিক বরাদ্দ ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকাকে ছাড়িয়ে গেছে। পরে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা করা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত বাজেট নথি অনুযায়ী, আসন্ন অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সোফর রেট বৃদ্ধির কারণেই মূলত সুদ পরিশোধের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
সাম্প্রতিক বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, 'বিশ্বজুড়ে রেফারেন্স রেটগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে ব্যবহৃত সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) ২০২২ সালের জানুয়ারিতে মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ উন্নত দেশ তাদের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে, সোফর-এর ৬-মাসের গড় বেড়ে ২০২৪ সালের মে মাসে ৫ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই কারণে, ইউরোপের উন্নত দেশগুলোসহ অন্যান্য উন্নত দেশ সুদের হার বাড়িয়েছে যা ইউরিবর, টোনা ইত্যাদি রেফারেন্স রেটকে প্রভাবিত করেছে।'
প্রকল্প ঋণ পাওয়া হবে ইয়েনে
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক ঘোষণা করেছে, এটি প্রকল্পের জন্য পরিকল্পিত সাড়ে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের পরিবর্তে সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে।
৬৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে সরকার জাপানি মুদ্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ঋণের সুদহার টোকিও ওভারনাইট অ্যাভারেজ রেট প্লাস ভ্যারিয়েবল রেট অনুসারে হবে।
এছাড়া, এসডিআর-এ দেড়শ মিলিয়ন ডলারের সমান ঋণ পাওয়া যাবে, যার জন্য কোনো সুদ নেওয়া হবে না। পাশাপাশি, এসডিআর-এ ১০০ মিলিয়ন ডলারের সমতুল্য একটি ঋণও নেওয়া হবে। এটির সুদহার হবে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ।
গত ২৯ মে কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্পের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকের কার্যবিবরণী অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি আলোচনাকারীদের জানান, তারা এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে একটি ঋণ বিশ্লেষণ করেছেন, যেখানে তারা দেখেছেন ইয়েনে ঋণে এ মুহূর্তে অন্য যেকোনো মুদ্রার তুলনায় বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে।
'এখন টোনা রেফারেন্স রেট হলো শূন্য দশমিক শূন্য ৭৭ শতাংশ এবং ভেরিয়েবল স্প্রেড শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ। অন্যান্য বিকল্প এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটি একটি ভালো বিকল্প,' তিনি বলেন।
এআইআইবি ঋণও ইয়েনে
বিশ্বব্যাংক ছাড়াও সরকার এআইআইবি'র অর্থায়ন করা প্রকল্পগুলোর জন্য ডলারের পরিবর্তে অন্যান্য মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার কথাও বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছেন ইআরডি কর্মকর্তারা।
তারা বলেন, উচ্চ বাজারভিত্তিক সুদহারের কারণে সরকার চলতি অর্থবছরে কোনো প্রকল্পের জন্য এআইআইবি থেকে কোনো ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে না। তবে এটি এআইআইবি'র কাছ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা ঋণ নেওয়ার কথা বিবেচনা করছে।
তারা আরও বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ডলার ছাড়া অন্য মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনাধীন রয়েছে।