বিশ্বব্যাপী উচ্চ সুদহারের মাঝে ডলারের বদলে ভিন্ন মুদ্রায় ঋণের কৌশল সরকারের
উচ্চ সুদহার মোকাবিলায় সরকার এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে মার্কিন ডলার ব্যতীত অন্যান্য মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে এআইআইবি'র সম্মতিও পাওয়া গেছে।
একইভাবে বর্তমানে মার্কিন ডলার ছাড়াও আরও তিনটি মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন ডলারে সোফর (সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট)-এর উচ্চ সুদহার এড়াতে এ পদক্ষেপের মাধ্যমে জাপানি ইয়েন, চীনা ইউয়ান বা ইউরোতে ঋণ নিতে পারবে সরকার।
ইআরডি'র তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এআইআইবি-এর পাইপলাইন তালিকায় ১৯টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের মোট ঋণ প্রস্তাব ৪.০৮ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ৩টি প্রকল্পের জন্য ১.০১৯ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য এনডিবি-এর সঙ্গে আলোচনা চলছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সোফর সুদহার বেড়ে যাওয়ায় উচ্চ সুদহারের কারণে সরকার দুই অর্থবছরের জন্য এআইআইবি থেকে কোনো প্রকল্প ঋণ নেয়নি। কেবল গত জুনে জাপানি ইয়েনে পাওয়া বাজেট সহায়তার ঋণ নিয়েছিল সরকার।
সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকার একই রকম উচ্চ সুদের কারণে এনডিবি'র ঋণের ক্ষেত্রে ধীরগতিতে এগিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ২০২১ সালে এনডিবিতে যোগ দেয়, তবে এ উন্নয়ন অংশীদারের কাছ থেকে এখনও কোনো ঋণ নেয়নি বাংলাদেশ।
বর্তমানে সোফর হার প্রায় ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর সঙ্গে অন্যান্য ফি যোগ করলে সুদ ৭ থেকে ৮ শতাংশ দাঁড়াতে পারে। ফলে বাংলাদেশ মার্কিন ডলারে ঋণের বিকল্প খুঁজছে। ডলারের বিপরীতে ইয়েনের মূল্য কম হওয়ার কারণে সরকার জাপানি ইয়েন ঋণে বিশেষভাবে আগ্রহী। এছাড়া, বিকল্প হিসেবে চীনা ইউয়ান বা ইউরোতে ঋণের সুযোগ রয়েছে।
ইয়েনে ঋণ নেওয়া হলে টোনা (টোকিও ওভারনাইট এভারেজ রেট) হারে সুদ দিতে হয়, যা বর্তমানে ১ শতাংশ। অন্যান্য ফিসহ এ সুদের হার দেড় শতাংশের মধ্যে থাকে। চীনা ইউয়ানের জন্য সিবর (চায়না থ্রি মান্থ ইন্টারব্যাংক রেট) এবং ইউরোর জন্য ইউরিবোর (ইউরো ইন্টারব্যাংক অফার রেট) ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুন: পরিশোধের চাপ কমাতে জাপানি ইয়েনে ঋণ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ
তবে টোনার তুলনায় সিবর ও ইউরিবোরের সুদহার বেশি হওয়ায় ইআরডি জাপানি ইয়েনে ঋণ নেওয়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এছাড়া, ডলারের বিপরীতে ইয়েনের ওঠানামার হার কম। বর্তমানে সিবর হার ১ দশমিক ৯ শতাংশ ও ইউরিবোর হার ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
ইআরডি'র কর্মকর্তারা জানান, কারেন্সি-স্যুইচিং ডেট সার্ভিসিং উচ্চ সুদহারের ঋণ পরিচালনার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি কৌশল। রিজার্ভ সংকট না থাকলেও বিকল্প মুদ্রায় ঋণ নেওয়া ভালো, কারণ এটি ঋণের উচ্চ সুদহারকে পিছিয়ে দেয়। বাংলাদেশ ঋণ নেওয়ার জন্য সম্প্রতি এ কৌশল গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জুন মাসে বাংলাদেশ জাপানিজ ইয়েনে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা ঋণ পেয়েছে। এছাড়া স্কেল-আপ উইন্ডো (এসইউডব্লিউ) প্রকল্প ইয়েনে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ নেওয়া হচ্ছে।
২২ জুন বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় বে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের জন্য সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। এ ঋণের ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সমতুল্য পরিমাণ জাপানি ইয়েনে নেওয়া হবে।
বিশ্বব্যাংক স্কেল-আপ উইন্ডো প্রকল্পের জন্য ঋণ বাজারভিত্তিক হার বা সোফর হারে নিতে হয়। ২৭ জুন বাংলাদেশ এআইআইবি থেকে ইয়েনের সমতুল্য ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে, যা পরে ডলারে রূপান্তরিত করা হয়।
ইআরডি কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকার ২৭ জুন পাওয়া এআইআইবি-এর বাজেট সহায়তা ডলারের পরিবর্তে ইয়েনে হওয়ার জন্য আলোচনা করেছিল। ফলে সরকার ওই দিনই ইয়েনে ৩৯০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পেয়েছে।
আরও পড়ুন: বিদায়ী অর্থবছরে বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি ৯% বাড়লেও ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচেই রয়ে গেছে
এ লেনদেনে ১০ মিলিয়ন ডলার কম পাওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘমেয়াদে এটি বাংলাদেশের জন্য উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। ঋণ ডলারে নিলে সোফর রেট এবং অন্যান্য ফিসহ সুদের হার প্রায় ৭ শতাংশ হতো।
তবে জাপানি ইয়েনে ঋণ নেওয়ায় সুদের হার ১ দশমিক ৩ শতাংশ দিতে হবে। এছাড়া ইয়েনে ঋণ পরিশোধের ফলে ইয়েনের বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ার ঝুঁকি কম থাকে, যা বাংলাদেশকে একটি সুবিধাজনক আর্থিক অবস্থানে রাখবে।
প্রকল্পের তালিকা
বর্তমানে রাজশাহী-রংপুর (৩৫০ মিলিয়ন ডলার) ও চট্টগ্রাম-সিলেট (৫৩১ মিলিয়ন) বিআরইবি নেটওয়ার্কের আধুনিকীকরণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি, মদুনাঘাট ৭৬৫ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন (৪৬০ মিলিয়ন), সমন্বিত পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন (৩১৫ মিলিয়ন), ঢাকা আরবান রিজেনারেশন (২০০ মিলিয়ন), ও গ্যাস সেক্টর এফিসিয়েন্সি ইমপ্রুভমেন্টসহ (২৮০মিলিয়ন) উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের জন্য এআইআইবি'র সঙ্গে আলোচনা চলছে।
অন্যদিকে এনডিবি'র ঋণে তিনটি প্রকল্পে অর্থায়ন করা হবে। এগুলো হলো ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পুরোনো গ্যাস পাইপলাইন মেরামত ও প্রতিস্থাপন (৪৩৪ মিলিয়ন ডলার), এক্সপান্ডেড ঢাকা সিটি ওয়াটার সাপ্লাই রেসিলিয়েন্ট প্রজেক্ট (৩২০ মিলিয়ন) এবং ন্যাচারাল গ্যাস নেটওয়ার্ক ক্যাপাসিটি অ্যান্ড সাপ্লাই এফিসিয়েন্সি ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্ট অব তিতাস গ্যাস (২৫৩ মিলিয়ন)।