ফেসবুক বন্ধ থাকায় লোকসানে জর্জরিত এফ-কমার্স উদ্যোক্তারা
গতকাল (২৮ জুলাই) দেশে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা পুনরায় চালু করার পরেও ফেসবুক পরিষেবা চালু না হওয়ায় হাজার হাজার এফ-কমার্স উদ্যোক্তাদের মুখে হাসি ফোটেনি যেহেতু তাদের পণ্য এবং পরিষেবার জন্য তারা সম্পূর্ণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ওপর নির্ভর করেন।
মোবাইল ইন্টারনেট এবং মূল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সংযোগ ১০ দিন বিচ্ছিন্ন থাকার পরেও ফেসবুক সহ মেটা পরিষেবাগুলো এখনও দেশে পুনরায় চালু না হওয়ায় এফ-কমার্স (ফেসবুক-কমার্স) উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ বাড়ছে।
পোশাক এবং পরিধানযোগ্য জিনিসপত্রের এফ-কমার্স ব্যবসা পরিচালনা করা রাজধানীর একজন ব্যাচেলর শিক্ষার্থী বলেন, "আমাদের ব্যতীত সব ধরনের অনলাইন বাণিজ্য ইতোমধ্যেই পুনরায় শুরু হয়েছে। আমি জানি না পরবর্তী আদেশের জন্য আমাকে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে।"
তিনি বলেন, "আমার একজন কর্মচারী আছেন যাকে আমাকে প্রতিদিন বেতন দিতে হয় এবং আমি এ কঠিন সময়ে তাকে ছাড়তে পারি না।"
তিনি জানিয়েছেন, ১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ হওয়ার আগে তার দৈনিক আয় ছিল ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। ফেসবুক-এর ভার্চুয়াল শপ বাংলাদেশ থেকে সকলের কাছে অ্যাক্সেসযোগ্য না হওয়ায় তার আয় শূন্যে নেমে এসেছে।
ঠিক কতজন অনলাইন বিক্রেতা এ তরুণ উদ্যোক্তার মতো ভুগছেন তা কর্তৃপক্ষের অজানা।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর হিসাব অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ফেসবুকে ৫ লাখেরও বেশি বাংলাদেশির নিজস্ব ব্যবসায়িক পেজ রয়েছে।
ই-ক্যাব-এর নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন বলেন, "সব পেজ শুধু ফেসবুক বা অনলাইন বিক্রেতাদের নয় কারণ ওমনি চ্যানেলের ব্যবসাও সেখানে উপস্থিত থাকে।"
তিনি অনুমান করে বলেন, এফ-কমার্স উদ্যোক্তারা প্রায় ২ থেকে ২.৫ লক্ষ ফেসবুক পেজ চালাচ্ছেন এবং এর মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার পেজে নিয়মিত বেচা-কেনা হয়।
অনলাইন কমার্স ইকোসিস্টেম পার্টনাররা অবশ্য বিশ্বাস করেন, সক্রিয় ফেসবুক বিক্রেতার সংখ্যা হয়ত এর থেকেও অনেক বেশি।
বিডি জবস, আজকেরডিল এবং ডেলিভারি টাইগার্স-এর প্রতিষ্ঠাতা একেএম ফাহিম মাশরুর টিবিএস কে বলেন, ২ থেকে ২.৫ লক্ষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিক্রেতার মধ্যে বেশিরভাগই প্রতি সপ্তাহে কম বা বেশি আয় করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সক্রিয় এফ-কমার্স বিক্রেতারা অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের কর্মকাণ্ড এবং ডেলিভারি পরিচালনা করার জন্য প্রায় ১০ লাখ চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করেছেন।
দেশ জুড়ে ই-কমার্স পারসেল বাছাই এবং বিতরণ করে এমন দুটি শীর্ষ স্তরের স্মার্ট লজিস্টিক সংস্থা জানিয়েছে, তাদের উভয়েরই লজিস্টিক ক্লায়েন্ট হিসেবে নিবন্ধিত প্রায় ২ লাখ এফ-কমার্স ব্যবসা রয়েছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস-এর সাবেক সভাপতি মাশরুর বলেন, বিক্রির নিম্নমুখী হার অব্যাহত থাকলে ছোট ব্যবসাগুলো দুর্বল হয়ে পড়বে এবং ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা মোটেও কম হবে না।
কিছু ফেসবুক গ্রুপ শত শত অনলাইন ব্যবসায়ীদের অনবোর্ডিং করে তাদের পণ্য বিক্রয় করতে সাহায্য করে।
স্মার্ট লজিস্টিক মার্কেটের পাশাপাশি খাদ্য সরবরাহ এবং রাইড শেয়ারিং ব্যবসার নেতৃত্ব দেয়া পাঠাও-এর সিইও ফাহিম আহমেদ টিবিএসকে বলেন, প্রায় সব এফ-কমার্স উদ্যোক্তাই তরুণ, শিক্ষিত ও প্রযুক্তি-সচেতন এবং ই-কমার্স, দ্রুত বাণিজ্য যেমন খাদ্য বা মুদি সরবরাহ ও রাইড শেয়ারিং থেকে তাদের টার্নওভার (মোট বিক্রির পরিমাণ) সামগ্রিকভাবে ৬৫ শতাংশ।
এছাড়াও দৈনিক ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার ই-কমার্স বিক্রয়ের মধ্যে মধ্যে এফ-কমার্সের অবদান প্রায় ৮০ শতাংশ। ফাহিম আহমেদ তার কোম্পানির পারসেল ডেলিভারি প্যাটার্নের বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে বলেছেন কারণ এটি বিক্রেতাদের পক্ষ থেকে অনলাইন ক্রেতাদের কাছ থেকে ডেলিভারির জন্য নগদ অর্থ সংগ্রহ করে।
ডেলিভারির সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় পাঠাও-এর মতো কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলো প্রতিদিন প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা লোকসান করছে।
ফাহিম আরও বলেন, যেহেতু এফ-কমার্স খদ্দেররা গত ১০ দিন ধরে নতুন অর্ডার পাননি সেহেতু তৃতীয় পক্ষের লজিস্টিক পরিষেবাগুলো শুধু মুলতুবি ডেলিভারি থেকে কয়েকটি পারসেল পাচ্ছে।
অনলাইনে গয়না বিক্রি করা রাজধানীর মিরপুর এলাকার একজন গৃহবধূ টিবিএসকে বলেন, "সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমার আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে। দারাজের মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো যখন আমার সেলস রেভিনিউয়ের (বিক্রয়লব্ধ আয়) ওপর দুই অঙ্কের কমিশন নেয় তখন আমার ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করতে ইন্টারনেট বিল ছাড়া আর কোনো খরচ লাগে না।"
অনলাইন বিক্রেতাদের পণ্য বিক্রয় এবং বিপণনের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের পণ্যের প্রচারের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লাইভ সেশনগুলো অনেক কার্যকরী এবং গ্রাহকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে অনেক সহায়তা করে।
তিনি আশা করেন, ইন্টারনেটের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো শীঘ্রই আবার চালু হবে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গতকাল (২৮ জুলাই) বলেছেন, মেটা এবং টিকটক কর্তৃপক্ষকে বুধবার (৩১ জুলাই) টেলিকম নিয়ন্ত্রকের সাথে একটি বৈঠকের জন্য ডাকা হয়েছে এবং তারা যদি উসকানিমূলক ও ভুল তথ্য সম্বলিত বিষয়বস্তু অপসারণের ক্ষেত্রে স্থানীয় আইনের প্রতি সম্মানশীল থাকে তবেই তাদের পরিষেবা পুনরায় চালু করা হবে।
গত মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) কেবল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পুনরায় চালু হওয়ার পর গতকাল বিকেল ৩ টায় মোবাইল ইন্টারনেট ১০ দিন পর পুনরায় চালু করা হয়েছে।