জানুয়ারিতে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোয় ফরেনসিক অডিট করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
সংকটে থাকা এক ডজনের বেশি ব্যাংকে একটি ফরেনসিক অডিট করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোতে হওয়া সম্ভাব্য জালিয়াতি, আর্থিক ক্ষতির অনুসন্ধান এবং ব্যাংকখাতের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো নিরসনে সংস্কারের সুপারিশ করা হবে।
এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে এরমধ্যেই হিসাব নিরীক্ষার বৈশ্বিক জায়ান্ট – কেপিএমজি, ডিলয়েট, আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং এর সাথে অডিট পরিচালনার জন্য আলোচনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিকখাত সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ব্যাংকিং খাত সংস্কারের লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। টাস্কফোর্সের একজন সদস্য বলেন, 'এটা স্পেশালাইজটা একটা অডিট হবে, যেখানে শুধু ব্যাংকের ঋণ-সম্পদ নয়, তাদের ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেটরও মান যাচাইয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে গোপনীয়তার রক্ষার চুক্তি থাকায় নাম না প্রকাশের শর্তে এসব কথা বলেন ওই সদস্য। তিনি আরও জানান, 'আমরা এসব ব্যাংকের ব্যালেন্সশিট ফরেনসিক অডিট করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে সুপারিশ করেছি।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) এই বিশেষ নিরীক্ষা কর্মসূচি এবং বাংলাদেশের ব্যাংকখাতের বৃহত্তর সংস্কারে অর্থায়ন করতে রাজি হয়েছে। এখানে কারিগরি সহায়তা দেবে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
টাস্কফোর্সের আরেক সদস্য জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে মন্দ ঋণ (নন-পারফর্মিং লোন) ও তারল্যের মতো বেশকিছু মৌলিক সূচকের ভিত্তিতে অডিটের জন্য ব্যাংকগুলোর শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'ডিসেম্বরেই বছর শেষ হচ্ছে, তাই জানুয়ারিতে অডিট ফার্ম নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, অডিট প্রক্রিয়ার পদ্ধতি ও কাঠামো নিয়ে বর্তমানে আলোচনা চলছে। 'পশ্চিমা দেশগুলোত ডিসেম্বর মাস হচ্ছে ছুটি ও উতসবের সময়, তাই আমরা জানুয়ারিতে অডিট শুরু করতে চাচ্ছি' - দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন মনসুর।
গত রোববারের এক সভাতেও বৈশ্বিকভাবে স্বনামধন্য নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা হয় বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বোর্ড সদস্য। তিনি বলেন, 'যদিও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। এই প্রোগ্রামের অর্থায়নকারী হিসেবে এফসিডিও পুরো প্রক্রিয়ায় বড় ভূমিকা রাখবে।'
বিপুল খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতিতে জর্জরিত ব্যাংকখাত
দীর্ঘদিন ধরেই খেলাপি ঋণের উচ্চ হার, দুর্বল শাসন ও একের পর এক ঋণ জালিয়াতিতে দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশের ব্যাংকখাত। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের বেশি সময়ের ব্যাংকখাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
যথেষ্ট সংখ্যক বেসরকারি ব্যাংক থাকার পরেও – আওয়ামীলীগ আমলে আরও প্রায় এক ডজন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব ব্যাংককে অনুমোদন দেওয়া হয় বলে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছিলেন যে, রাজনৈতিক কারণে এসব লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পর থেকেই ব্যাংকখাতে একের পর এক বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারি সামনে আসতে থাকে, এতে করে ব্যাংকখাতের দুর্বলতাগুলো দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
২০১০ সালের শুরুতে ব্যাংকখাতে অন্যতম চাঞ্চল্যকর ঋণ জালিয়াতির জন্য হলমার্ক গ্রুপের নাম সামনে আসে, অখ্যাত এই কোম্পানি কাগজপত্র জাল করে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নেয় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে।
এরপরেই সামনে আসে বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারি। রাজনৈতিক বিবেচনায় এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তার সময়েই ব্যাংকটি ৪ হাজার কোটি টাকার উপরে ঋণ দেয় জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে। প্রায় এক দশক আগে চেয়ারম্যান পদ থেকে বাচ্চুকে অপসারণ করা হলেও – আজো চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে ব্যাংকটি।
আরও সাম্প্রতিক সময়ে এসে, সম্পদের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক – ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে ব্যাপক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠতে শুরু করে। এই ব্যাংকের দখল নেওয়ার পর বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে চট্টগ্রাম-ভিত্তিক এস আলম গ্রুপ শত শত কোটি ডলার পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত অক্টোবরে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অভিযোগ করেন যে, শেখ হাসিনার সময়ে দেশের ব্যাংকখাত থেকে অন্তত ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছে। এরমধ্যে এস আলম গ্রুপ ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
'দায়ী রাজনৈতিক হেভিওয়েটরা'
বাংলাদেশের অর্থনীতির শ্বেতপত্রে ব্যাংকখাতকে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত শিল্প হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শ্বেতপত্রে ২০২৪ সালের জুন শেষে ব্যাংকখাতে ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক 'হেভিওয়েটদের' সম্পৃক্ততাকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যা মোট ঋণের ৩১.৭ শতাংশ।
ব্যাংকখাত সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্সের একজন সদস্য ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুহাম্মদ এ. (রুমী) আলী বলেন, 'সংকট কতোটা তীব্র তার প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ এবং ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য খতিয়ে দেখতে অডিট করতে হবে।'
তবে তিনি মনে করেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর সার্বিক উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিৎ হবে, তাদের নির্দিষ্ট কিছু কাজ করতে বলা এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া।
গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার গঠনের পর আহসান এইচ মনসুরকে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার আগে গভর্নর ছিলেন আব্দুর রউফ তালুকদার, আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পরে যিনি পদত্যাগ করেন।
তখন থেকে সংকটে থাকা বেশকিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে– সেগুলোকে আওয়ামীলীগের ঘনিষ্ঠ কতিপয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংককে কয়েক সপ্তাহ ধরে তারল্য সহায়তা বা নগদ অর্থের জোগানও দেওয়া হয়; কিন্তু এতেও নগদ অর্থের সংকট না কাটায়– বাধ্য হয়ে নতুন টাকা ছাপিয়ে তাদেরকে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি সহায়তা দেওয়া হয়েছে।