আদনান ইমামের ২ কোম্পানির খেলাপি ৬৮৭ কোটি টাকা, বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে ইউসিবি পাবে মাত্র ৮০ কোটি
গতকাল (১৯ ডিসেম্বর) তিনটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি হওয়া ১,০৬৭ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা সম্পত্তির নিলাম বিক্রয়ের দরপত্র ডেকেছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) পিএলসি। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন এনআরবিসি কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমাম।
ইউসিবির কারওয়ান বাজার শাখায় আদনানের দুটি প্রতিষ্ঠান এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্টস (বিডি) ও এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেটের মোট খেলাপি ঋণ ৬৮৭ কোটি টাকা। এছাড়া একই শাখায় বাংলা-ইউকে এগ্রো প্রোডাক্টসের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৮০ কোটি টাকা।
কিন্তু নিলামে প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পত্তি বিক্রি করে সর্বোচ্চ ৮০ কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে জানিয়েছে ব্যাংকের একটি সূত্র।
নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, আদনানের দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে গুলশানে অবস্থিত ২৭ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস বন্ধক রাখা হয়েছে।
তবে এই সম্পত্তি বিক্রি করে সর্বোচ্চ ৬০ কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে। এর ফলে ইউসিবি ব্যাংককে বড় অঙ্কের ঘাটতি পূরণ করতে হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
তিনি আরও জানান, বাকি ঋণ আদায়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পাশাপাশি এসব ঋণ বের করে নিয়ে বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বিনিয়োগ করা হলে সেসব প্রতিষ্ঠানও আইনিভাবে জব্দ করা হবে।
'এছাড়া পাচার করে থাকলে সেটা ফিরিয়ে আনার আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে,' বলেন তিনি।
যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর-এর (আরজেএসসি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আদনান ইমাম এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্টস ও এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেট উভয় কোম্পানির চেয়ারম্যান। একটি প্রতিষ্ঠানে তার বাবার নাম চৌধুরী ফজলে ইমাম ও অপরটিতে এ কে মঈনুদ্দিন উল্লেখ করা হয়েছে।
দুই প্রতিষ্ঠানেরই মূলধন ১০ কোটি টাকা করে।
এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্টস ঢাকার বনানীর ২৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের এ আর টাওয়ার-এ নিবন্ধিত। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালাহউদ্দিন নাসির। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছেন চৌধুরী ফজলে ইমাম (৮০ হাজার শেয়ার), মোহাম্মদ আদনান ইমাম (১.৮০ লাখ শেয়ার) ও তার স্ত্রী নীলুফার ইমাম (১.৪০ লাখ শেয়ার)।
এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেট উত্তরার সেক্টর-০৭-এর সৈয়দ গ্র্যান্ড সেন্টারে নিবন্ধিত। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালাহউদ্দিন নাসির (এক্স-অফিসিও)। এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছেন চৌধুরী ফজলে ইমাম (২৫ হাজার শেয়ার) ও মোহাম্মদ আদনান ইমাম (২৫ হাজার শেয়ার)।
আদনান ইমামের মন্তব্য জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোনকলের জবাব দেননি।
বাংলা-ইউকে এগ্রো প্রোডাক্টস
আরজেএসসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলা ইউকে এগ্রো প্রোডাক্টসের নিবন্ধিত মূলধন মাত্র ১ কোটি টাকা ও প্রতি শেয়ারের দাম ১০ টাকা।
কোম্পানিটি ছয়জন পরিচালকের মালিকানাধীন—মেজবাহ উদ্দিনের শেয়ার সংখ্যা ৪ হাজার, শাহাদাত হোসেন তৌফিকির শেয়ার সংখ্যা জানানো হয়নি, জাহিদুল ইসলামের শেয়ার ১৫ হাজার, রোকেয়া ইসলামের শেয়ারসংখ্যা ৮ হাজার, বোরহান উদ্দিন চৌধুরীর শেয়ারসংখ্যা ৮৫ হাজার ও আমের রাসুলের শেয়ার ৮৭ হাজার ৫০০টি।
তবে ইউসিবির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, বাংলা-ইউকে এগ্রো প্রোডাক্টসের অন্য শেয়ারহোল্ডার থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানটিও আদনান ইমামের। তারা বলেন, প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা দেখানো হয়েছে: প্লট-৩৫, ফ্ল্যাট-৫(এ), এডব্লিউআর ইউ টাওয়ার, রোড-১৩৩, গুলশান-১—অর্থাৎ আদনান ইমামের মালিকানাধীন একটি ভবনে এই কোম্পানির ঠিকানা।
কোম্পানিটির নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে গাজীপুরে ১৯৭ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ২০ কোটি টাকা।
বাংলা-ইউকে এগ্রোর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজবাহ উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কোম্পানিটি নিয়মিত ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং আইনি প্রক্রিয়া মেনে ঋণ নিয়মিত করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, 'তবে আমি আপনার কাছ থেকেই জানলাম ঋণের বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলা হচ্ছে। এই খবরে আমি পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি।'
মেজবাহ আরও বলেন, 'যদিও বন্ধকি সম্পত্তির দাম যথেষ্ট না হলেও আমাদের কারখানার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। আমাদের মৎস্য প্রকল্পগুলো প্রায় ৬০ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে। এই জমির পুরোটা আমাদের কোম্পানির মালিকানাধীন।'
বাংলা-ইউকে এগ্রো ও আদনান ইমামের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের কোম্পানির সঙ্গে আদনানের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।'
তবে কোম্পানির ঠিকানা এডব্লিউআর ইউ টাওয়ারে তালিকাভুক্ত থাকার বিষয়ে মেজবাহ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ইউসিবির কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়েছে সিআইডি
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট গত ৮ ডিসেম্বর ইউসিবি ব্যাংকের কাছে ৬৪ জন ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংকের ৩০ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিস্তারিত তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তের অংশ হিসেবে এ চিঠি পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিক সুবিধা আদায় এবং অনিয়মিত ঋণ অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন।
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ এবং ঋণ প্রদানের অনিয়মে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত এইচআর ফাইল এবং তাদের সুপারিশে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে সাইফুজ্জামান ও তার পরিবারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। শাখা ব্যবস্থাপকদের ওপর চাপ তৈরি এবং যথাযথ যাচাই ছাড়াই উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ প্রস্তাবও অনুমোদন করেছেন তারা।
ইউসিবির যেসব কর্মকর্তার তথ্য চাওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ কাদেরী ও শওকত জামিল, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল আলম ফেরদৌস ও নাবিল মুস্তাফিজুর রহমান এবং সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হামিদুজ্জামান।
ইউসিবির সাবেক ক্রেডিট অফিসার শরীফ আবদুল্লাহ বলেন, 'সিআরএমডি প্রধান হিসেবে নাবিল মোস্তাফিজুর রহমান সরাসরি তিনটি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।'
তিনি অভিযোগ করেন, নাবিল ভুয়া রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট প্রস্তুত করে ঋণ প্রস্তাবগুলোকে লাভজনক হিসেবে দেখান এবং শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরকে যথাযথ যাচাই ছাড়াই ঋণ অনুমোদন ও বিতরণে বাধ্য করেন।
তিনি আরও বলেন, অনিয়ম করে এসব ঋণ হাতিয়ে নিয়েছেন ইউসিবির সাবেক চেয়ারপারসন রুখমিলা জামানের স্বামী সাইফুজ্জামান, তার ভাই আনিসুজ্জামান রনি এবং নাবিলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আদনান ইমাম।
ইউসিবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ মাহমুদুর রশিদের মন্তব্যের জানার জন্য ফোনকল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।