ডলারের রেফারেন্স রেট, ক্রয়-বিক্রয়ে দামের ব্যবধান ঠিক করে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
সাত মাস আগে ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা চালু করার পর বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বাজারদরের প্রতিক্রিয়ায় প্রতি ডলারের মধ্যবর্তী দর (মিড-রেট) ১.৫ থেকে ২ শতাংশ বাড়িয়ে ১১৭ টাকা থেকে নতুন দাম নির্ধারণ করতে যাচ্ছে।
এছাড়া, ডলারের জন্য একটি রেফারেন্স রেট চালুর ঘোষণা দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে একই বিনিময় হার প্রয়োগ করতে নির্দেশ দিয়েছে এটি।
যেসব ব্যাংক এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করবে, সেগুলোর জন্য শাস্তি হিসেবে ন্যূনতম ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) লেনদেনের ৫ শতাংশ জরিমানা নির্ধারণ করা হবে।
সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রায় ৪০টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ট্রেজারি প্রধানদের সঙ্গে এক বৈঠকে এ নির্দেশনা তুলে ধরেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারেরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এ নির্দেশনাগুলো একটি সার্কুলার আকারে প্রকাশ করা হবে।
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের চারজন উপ-গভর্নর ও সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের নির্বাহী পরিচালকেরা উপস্থিত ছিলেন।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জানান, এখন থেকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হার নির্ধারণ করা যাবে না। তিনি বলেন, 'দুই ধরনের ডলার প্রবাহের জন্য অভিন্ন হার প্রয়োগ করতে হবে।'
এর পাশাপাশি গভর্নর ডলার ক্রয়-বিক্রয়ে সর্বাধিক ১ টাকার ব্যবধান রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। আরেক এমডি বলেন, 'নতুন রেফারেন্স রেটের আশপাশে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ডলার লেনদেনের অনুমতি পাবে ব্যাংকগুলো।'
এছাড়া ব্যাংকগুলোকে তাদের বিনিময় হার প্রকাশ করতে হবে এবং এসব রেট অনুযায়ী লেনদেন নিশ্চিত করতে হবে। এ লেনদেনের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে হবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বচ্ছতার নিমিত্তে প্রতিদিন দুবার সামগ্রিক বাজারদর প্রকাশ করবে।
নির্দেশনা মানার বিষয়টি পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে একটি অভিযোগ সেল গঠন করবে। ব্যাংকিং খাত বা ভুক্তভোগী গ্রাহকদের কাছ থেকে অভিযোগ পেলে সেগুলোর যথাযথ তদন্ত করা হবে।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, গভর্নর সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, প্রতিটি অভিযোগ তদন্তের পর ডলার লেনদেনে নির্ধারিত সীমার বেশি চার্জ করা বা অতিরিক্ত মুনাফার প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থায় যাওয়ার লক্ষ্য রয়েছে।
'তার আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন এসব পদক্ষেপ বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা আনবে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য প্রবাহে অ্যাক্সেস থাকা ব্যাংকগুলোর বৃহত্তর সম্পৃক্ততার মাধ্যমে বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বাড়ানোর বিকল্প উদ্যোগ নিচ্ছে। এটি একটি গভীর আন্তঃব্যাংক বাজার বিকাশে সহায়তা করবে।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ টিবিএসকে বলেন, নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে রপ্তানিকারক ও রেমিট্যান্স প্রেরকদের কাছ থেকে ডলার কেনার হারে সমন্বয় আনতে হবে।
'ফলে যে-সব ব্যাংক রেমিট্যান্সের জন্য অস্বাভাবিক ডলার হার অফার করত, তারা এখন আরও সতর্ক থাকবে,' তিনি বলেন।
গভর্নর ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে 'মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড' গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা বাজারের অস্থির সময়ে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বৈঠকে বৈদেশিক মধ্যস্থতাকারী ও অ্যাগ্রিগেটরদের কার্যক্রমের বিষয়েও আলোচনা হয়। এ পক্ষগুলোর প্রভাবেও সাম্প্রতিক সময়ে বিনিময় হার বেড়ে গেছে এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
গভর্নর ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন, বিনিময় হার পরিবর্তনের ফলে যে সুবিধা আসে, তা যেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমদানিকারকদের কাছে পৌঁছানো হয়। তিনি অ্যাগ্রিগেটরদের মাধ্যমে সুবিধার অপব্যবহার রোধে সতর্ক থাকতে বলেন।
ঢাকা ব্যাংকের শেখ মারুফ বলেন, 'যদি সব ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে চলে, তাহলে রেমিট্যান্স হাউস ও এগ্রিগেটরদের বাজার কারসাজি বন্ধ করা সম্ভব।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বৈঠকে আমদানি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।
গভর্নর উল্লেখ করেন, আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি, তবে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ শক্তিশালী হয়েছে। তা সত্ত্বেও ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণ নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন।
জবাবে ব্যাংকগুলো আমদানি অর্থপ্রদানের চূড়ান্ত মেয়াদের চাপ, ২.৫ বিলিয়ন ডলারের বকেয়া অর্থপ্রদান এবং রেমিট্যান্স অ্যাগ্রিগেটরদের কার্যকলাপ ইত্যাদি প্রভাবের কথা বলে। এছাড়া, ডিসেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কথাও উল্লেখ করা হয়।
এসব ব্যাখ্যা শোনার পর আহসান এইচ মনসুর ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে নতুন পদক্ষেপের কথা প্রকাশ করেন।
১৯ ডিসেম্বর গভর্নর টিবিএসকে বলেছিলেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ ঘাটতি বা অতিরিক্ত চাহিদা কোনোটিই নেই। তবে রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে ১১৮-১১৯ টাকায় এবং রেমিট্যান্স প্রেরকদের কাছ থেকে ১২৭ টাকায় ডলার কেনার ঘটনাকে তিনি অনৈতিক বলে উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার অভিন্ন বিনিময় হারকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, 'একটু ভালো হার আমাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও সহায়ক হবে।'
রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে সুবিধা নিতে না পারা, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, ব্যাংকের তারল্য সহায়তার সীমাবদ্ধতা এবং ক্রেতাদের মূল্য হ্রাসের কারণে তৈরি পোশাক খাত নানা সমস্যার মুখে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।