বাস্তবায়নে দেরি আর ব্যয় বৃদ্ধিতে দশকব্যাপী ধুঁকছে রেলওয়ের প্রকল্প
সরকারি অনেক প্রকল্পে নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে বেশি ব্যয়ের ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই শোনা যায়। বাস্তবায়ন কাজে মন্থর গতির কারণে মেয়াদও বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু, সবাইকে যেন ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সরকারি বিভাগটির কিছু প্রকল্প অবিশ্বাস্য ধীরগতির। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যয় ৮৭৩ শতাংশের মতো নজিরবিহীন পরিমাণে বেড়েছে।
যেমন ছয় বছরের মধ্যে ৭০ মিটার গেজ লোকোমোটিভ সংগ্রহের একটি প্রকল্প এক দশক পরও বাস্তবায়িত হয়নি।
২০১১ সালে গৃহীত এ প্রকল্পের মেয়াদ তিন বার বাড়ানোর পরও অগ্রগতির পরিমাণ শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। ১ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকার প্রাথমিক ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। এরপরও প্রকল্পটি কবে নাগাদ শেষ হবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
একইরকম কচ্ছপগতিতে এক দশক ধরে চলমান রেলওয়ের আরও তিনটি প্রকল্প। প্রশ্নবিদ্ধ অগ্রগতি সত্ত্বেও একাধিকবার মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এই দেরির জন্য প্রকল্প চলাকালীন অবস্থায় নকশা ও উৎস পরিবর্তন, অর্থায়নের ধরন বদলানো এবং তহবিল ছাড়করণে দীর্ঘসূত্রিতাকে দায়ী করছেন কর্মকর্তারা।
এছাড়া, বেশিরভাগ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণ না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়করা নানান ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলেও জানান তারা।
মহামারির কারণে প্রকল্পের গতি আরো কমে যায় বলেও দাবি তাদের।
বর্তমানে রেলওয়ের চলমান প্রকল্পের সংখ্যা ৪১টি। যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে অন্তত ২০টি প্রকল্পের মেয়াদ এক থেকে চারবার পর্যন্ত বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে ব্যয়ও বেড়েছে বিপুল পরিমাণে।
দেশে একটি শক্তিশালী এবং সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থার জন্য ট্রেন পরিষেবা বৃদ্ধি এবং এর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য ২০১৩ সালে অনুমোদিত রেলওয়ের প্রথম মহাপরিকল্পনা অনুসারে প্রকল্পগুলি নেওয়া হয়েছিল।
মাস্টারপ্ল্যানের ফেইজ-ভিত্তিক ভিশনের আওতায়, ২০১৯-২০২৩ মেয়াদে রেলওয়ের কাছে ৩৪৬টি লোকোমোটিভ ও ১ হাজার ৮৩২টি কোচ থাকার কথা। অথচ বর্তমানে সেবা দানকারী সংস্থাটির হাতে রয়েছে মাত্র ২৪৯টি লোকোমোটিভ এবং ১ হাজার ৬৭১টি কোচ। রেলওয়ের সাম্প্রতিক বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারেই জানা গেছে এসব তথ্য।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যানুসারে, ২০১১ সালের জুলাইয়ে ৭০ মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহের প্রকল্প নেওয়া হয়। এর নির্ধারিত মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত ছয় বছর। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় প্রক্ষেপণ করা হয় ১ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা।
এই ক্রয় প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আগ্রহী দরদাতাদের জন্য ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনবার দরপত্র আহবান করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে কেউই তাতে সাড়া দেয়নি।
এরপর ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয় কোম্পানি হুন্দাই রোটেম এর সাথে লোকোমোটিভ ক্রয়ের ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকার একটি চুক্তি সই হয়। এতে অর্থায়ন করার কথা ছিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং জাপানের সুমিতোমো মিতসুই ব্যাংকিং কর্পোরেশনের।
তবে ১৫ শতাংশের বেশি সুদ হওয়ায় একে কঠিন শর্তের ঋণ হিসেবে উল্লেখ করে এটি গ্রহণে অস্মমতি জানায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। ফলে এই ঋণ চুক্তি আর এগোয়নি।
তারপরেও, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ তিনবার বাড়িয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত করেছে।
এবিষয়ে ৭০ মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ ক্রয় প্রকল্পের পরিচালক আহমেদ মাহবুব চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "অর্থায়নের সমস্যার কারণে প্রকল্পটি কোনো অগ্রগতি লাভ করেনি। অর্থ বিভাগ সহজ শর্তের ঋণগ্রহণে জোর দিচ্ছে, কিন্তু তা পাওয়া যাচ্ছে না।"
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দরপত্র আহবানের আগে তহবিলের ব্যবস্থা করেন কর্তৃপক্ষ। তবে এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি বলে জানান তিনি।
অর্থ বিভাগ আগেই সহজ শর্তের ঋণের জন্য উদ্যোগ নিলে বা সময়মতো তহবিল যোগাড় করলে এত দীর্ঘ দেরি হতো না বলেও জানান প্রকল্পটির পরিচালক।
বর্ধিত মেয়াদ শেষ, তবুও অসমাপ্ত প্রকল্প:
প্রায় ৬৫ কিলোমিটারের খুলনা-মোংলা বন্দর রেললাইন অত্যন্ত ধীর গতির রেল প্রকল্পের আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ।
২০১০ সালে ডিসেম্বরে এ প্রকল্প শুরু হয়, যা ২০১৪ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এক দশকের বেশি সময় ধরে এর বাস্তবায়ন ঝুলে আছে। এর মেয়াদ আরো দেড় বছর বাড়ানো হয়েছে।
সব মিলিয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে চার বার। প্রাথমিক ব্যয় ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা ধরা হলেও, তা থেকে প্রায় ১২১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা।
শুরুর পর থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়েছে ৮৪ শতাংশ। এখন এটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, 'দেরির অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো মহামারি। আমরা ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই বাস্তবায়ন কাজ শেষ হওয়ার আশা করছি।"
দোহাজারী- কক্সবাজার প্রকল্প: বিলম্বের আরেক উদাহরণ
ট্রান্স-এশীয় রেল করিডরের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং পর্যটন নগরে যোগাযোগ সুবিধা বাড়াতে ২০১০ সালে এ প্রকল্প নেয় সরকার। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের জুনে। এ প্রকল্পের মেয়াদও কয়েকবার বাড়িয়ে সর্বশেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২২ সালের জুন মাস।
এক দশক পরও চলতি বছরের অক্টোবর নাগাদ বাস্তবায়নে সার্বিক অগ্রগতি ছিল ৬৪ শতাংশ।
প্রকল্প কর্মকর্তারা দেরির প্রসঙ্গে বলছেন, ১২৮ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ স্থাপনে এটি শুরু করা হয়। তবে তিন বছর পরই কর্তৃপক্ষ আগের সিদ্ধান্ত বদলে ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে আরো ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন দেখা দেয় এবং খরচও বেড়ে যায়।
প্রকল্পের নকশাও বদলেছে। ফলে ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার প্রাথমিক ব্যয় ১০ গুণ বেড়ে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখে পৌঁছেছে।
ত্রুটিপূর্ণ নকশায় পিছিয়ে পড়েছে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ:
প্রতিবেশী ভারতের সাথে আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে ২০১০ সালে এ প্রকল্প নেয় সরকার। যা ২০১৭ সালের জুনে শেষ করার লক্ষ্য ছিল।
বেশ কয়েকবার মেয়াদ বাড়িয়েও ১০ বছর পর এর বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৭০ শতাংশ।
এখন ২০২২ সাল নাগাদ ৫২.৫৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ শেষ করার লক্ষ্য নেওয়া হলেও, গত ছয় মাসে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
বাস্তবায়নের এই শম্বুকগতির কারণেই এটি বর্ধিত সময়েও শেষ হবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
প্রকল্প নকশায় ত্রুটি এবং আর্থিক অনুমোদনে দেরিকেই এজন্য দায়ী করেছেন প্রকল্প পরিচালক মো. সুলতান আলি।
তিনি জানান, প্রথমে মিটারগেজ লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী দেশে নতুন করে নির্মাণাধীন সকল রেলপথকে ডুয়েল বা ব্রড গেজ করার নির্দেশনা দেন। সেই অনুসারে প্রকল্প নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। একারণে ২০১৮ সালের আগে প্রকল্পের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।
ভারতীয় ঋণচুক্তির আওতাধীন এ প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের বিলম্বের কারণেও কাজ পিছিয়ে যায় বলে জানান সুলতান আলি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বেড়েই চলেছে। তাছাড়া, দেশ প্রকল্পগুলো থেকে প্রত্যাশিত সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে।
পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক মনে করেন, বিচ্ছিন্ন ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং জবাবদিহিতার অভাবেই প্রকল্পগুলি দীর্ঘদিন ধরে চলছে।
"সব কয়টি প্রকল্পই রেলওয়ের মহাপরিকল্পনার অংশ। দেরির কারণে সরকারও এসব প্রকল্পের কোনো সুফল পাচ্ছে না। উল্টো সময় ও খরচ বৃদ্ধির কারণে ক্ষতির শিকার হচ্ছে।"
তার মতে, জাতীয় উন্নয়নের দর্শন বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক বিচারে পরিচালিত হওয়া উচিত।