চুলের ভ্রমণ বৃত্তান্ত: আপনার চুলের ব্রাশ থেকে যেভাবে চীনে পৌঁছে!
সিরাজ আর সোহেল (ছদ্মনাম) হলেন বন্ধু ও ব্যবসায়ীক অংশীদার। তাদের ব্যবসাটি মোড়া গোপনীয়তার চাদরে।
ঢাকায় অবস্থানকালে তারা থাকেন দেওয়ানবাড়ির দুই বেডরুমের সাদামাটা বাড়িতে, কিন্তু গোপন ব্যবসার কাজে তাদের বেশিরভাগ সময়েই বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়।
দৈহিক গড়নে সিরাজ একটু বেঁটেখাটো মোটা আকৃতির। তিনি শার্ট ইনক করে তার ওপর চড়িয়েছিলেন সোয়েটার। পান চিবানোর প্রতি তার তীব্র আসক্তির প্রমাণ দেয় সর্বদা লাল ঠোঁট। অপরদিকে, সোহেল পাতলা ও দীর্ঘাকৃতির। লুঙ্গি আর শার্টের মতো সাধারণ পোশাকেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি। মন খুলে খুঁটিনাটি বিষয় জানাতে তার সংকোচও কম।
দুই বন্ধুর দেওয়ানবাড়ির বাসাটিকে বাইরে থেকে দেখে সরু গলির ভেতরের আর পাঁচটা বাড়ি থেকে আলাদা মনে হয় না। কিন্তু, বাসার ভেতরে গেলেই সেই ভ্রম কাটে। বাসাটিতে নেই তেমন কোনো ছবি বা আসবাব। অগোছালো বিছানা ও মশারি টাঙ্গানো শোবার ঘরে, সেখানে রাখা একটি টেবিল ও দুটি মোড়া। তাতেই যেন সংকীর্ণ ভাব চলে এসেছে।
শোবার ঘরেই বসতে হবে মোড়া পেতে। সেদিকে যেতে যেতে ব্যাখ্যা দিতেই যেন সোহেল বললেন, "আমরা দুজনেই সংসারী মানুষ নই, তাই এতোটা অগোছালো। আসলে ব্যাচেলর, দয়া করে কিছু মনে করবেন না।"
ঘরে রাখা টেবিলটির ওপর রাবার ব্যান্ডে পরিপাটি করে বাঁধা রয়েছে কয়েক গাছি চুল। এই দৃশ্য কৌতূহল জাগানিয়া তো অবশ্যই। বিশেষ করে অতিথি যদি এখানে আসার আগে এই দুই হেয়ার এজেন্টের জটিল ও গোপনীয় চুল ব্যবসার কথা না জানেন, তারা বিস্মিতও হবেন। এ ব্যবসাই তাদের জীবিকার মাধ্যম।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্যানুসারে, গেল ২০২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে তিন কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের মানব চুল ও পরচুলা রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
তবে অনিবন্ধিত হওয়ায় এই পরিসংখ্যানে নেই সিরাজ ও সোহেলের ব্যবসা। শুধু তারাই নন, সোহেল জানান বৃহত্তর ফরিদাবাদ এলাকায় এমন অন্তত ৫০০ জন ব্যক্তি একই ব্যবসায় জড়িত।
"আগের জীবনে চোর-ডাকাত ছিলাম, কিন্তু এই ব্যবসা পেয়ে নিজেদের বদলেছি। এই ব্যবসা আরও লাভজনক, কোনো অপরাধ না করে বিনা ঝুঁকিতে করা যায়"- বলছিলেন সোহেল।
খোলামেলা এই আলোচনা চলাকালে সোহেল ও সিরাজ একে -অপরের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন। যেন বুঝতে চাইছেন যা বলছেন তা নিয়ে যেন আরেক বন্ধুর কোনো সম্মতি আছে কিনা। সোহেল-ই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে আলাপ চালিয়ে যান, সে তুলনায় একটু গম্ভীর ছিলেন সিরাজ।
তাদের মতে, চুল বাণিজ্য একটি সূক্ষ্ম পদ্ধতি ও অনেকগুলি স্তরে বিন্যস্ত।
চুল ব্যবসার গোলকধাঁধা ও অংশগ্রহণকারীরা:
বাড়ি ও বিউটি সেলুনগুলোর ফেলে দেওয়া চুল সংগ্রহ করে এক শ্রেণির হকার। অনেক সময় তারা খেলনা, পুতুল বা চকলেটের বিনিময়ে বাসাবাড়ি থেকে চুল কেনে।
সিরাজ বলেন, "দেশের প্রায় সকল জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আমাদের এমন লোক রয়েছে। গত ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসায় আছি। সময়ের সাথে সাথে এই সিস্টেম আরও বিস্তৃত হয়েছে।"
সিরাজের মতো চুলের এজেন্টদের কাছ থেকেই খেলনা ও অন্যান্য বিনিময় পণ্য কেনার টাকা পান হকাররা। তাদেরকে এক হাজার টাকা মূল্যের পণ্য দিয়ে একজন এজেন্ট এক কেজি বা পাঁচ হাজার টাকার চুল কিনতে পারেন।
নিজেকে একজন অগ্রদূত এজেন্ট দাবি করে সিরাজ বলেন, "১৯৯৩ সালে আমিই প্রথম এই আইডিয়া কাজে লাগাই।" তার কণ্ঠে স্পষ্ট ছিল গর্ব ও আত্মবিশ্বাসের সুর।
একজন হকার 'কাঁচা' চুল সংগ্রহের পর একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে সোহেল বা সিরাজের মতো এজেন্টের কাছে তা বিক্রি করে। "আমাদের ক্ষেত্রে আমরা লালনের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। সে মিরপুর এলাকায় সংগ্রহ করে শহরের এই প্রান্তে নিয়ে আসে"- সিরাজ বলছিলেন।
সংগ্রহ করা চুল প্রথমে জট পাকানো ও অবিন্যস্ত থাকার কারণেই আমরা একে 'কাঁচা' চুল বলি বলে জানান সোহেল। "কাঁচা চুল পাঠানো হয় বিভিন্ন মফস্বল শহরে। সেখানে মহিলা কর্মীরা চুলের জট ছাড়ানোর কাজ করেন। শেরপুরের মতো মফস্বল শহরে আমাদের অনেক নারী কর্মী রয়েছে।"
চুলের জট ছাড়াতে শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট পাউডার, কেরোসিন তেল ও পানি ব্যবহার করা হয়। পরিষ্কার করা চুল সোজা করে শুকাতে দেন কর্মীরা। আট ইঞ্চি লম্বা কাঁটার সাড়িসহ একটি বড় চিরুনির মতো উপকরণ ব্যবহার করে চুলের গোছাগুলি দৈর্ঘ্য অনুসারে বাছাই করা হয়। বাছাইয়ের পর গোছাগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা হয়।
হেয়ার এজেন্টদের মতে, একজন নারী কর্মী দিনে ১০০ গ্রাম চুলের জট ছাড়াতে পারেন এবং সেজন্য মাত্র ৫০ টাকা পান। চুল প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য দেশের চুলের কারখানার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মজুরি শেরপুরে, যেখানে এক কেজি প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ হয় ৮০০ টাকা।
সোহেল হাতের ইশারায় সিরাজকে দেখিয়ে বলেন, "এই ব্যবসার একাধিক পর্যায় থাকায় শুধু আমাদের দুজনেরই ২২০০ কর্মী রয়েছে, এই ব্যবসা অনেক ব্যাপক। সিরাজের অধীনে কমপক্ষে এক হজার কর্মী কাজ করছে।"
২০০০ সাল থেকে, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল এবং গাজীপুর জেলার কিছু গ্রামে চুল প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সিরাজের শেরপুরে কর্মচারী থাকলেও; সোহেলের ঘাঁটি চুয়াডাঙ্গায়।
এই ব্যবসা করে কতো টাকা আয় করেন? জানতে চাইলে মুচকি হেসে সোহেল বলেন, "হিসাবকিতাব প্রকাশ না করাই ভালো। বিষয়টি আমরা সব সময় গোপন রাখি।" এনিয়ে অনেক অনুরোধ করার পরও তারা গোপন রাখার সিদ্ধান্তেই অনড় থাকেন।
দেশে চুলের দুটি বড় বাজার রয়েছে, একটি চুয়াডাঙ্গায় এবং অন্যটি নওগাঁয়; যেখান থেকে ফায়দাবাদের হেয়ার এজেন্টরা নন-রেমি (নিম্ন মানের এবং সস্তা দামের) পনিটেল চুলের গোছা বিক্রি করে। আর আছে রেমি মানের চুল, এটিই বেশি কাঙ্ক্ষিত ও মানসম্মত।
মফস্বল শহর থেকে জটহীন চুল ঢাকা শহরে, প্রধানত উত্তরার ফায়দাবাদে ফিরে আসে। তারপর আবার প্রক্রিয়াজাত করে বাল্ক আকারে বিক্রি হয়। আবার একটি ধাপ অতিক্রম করার পর এটি চুলের 'ক্যাপ' তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এই ক্যাপই হচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ পরচুলা পণ্য।
সিরাজ বলেন, "আমরা ক্যাপ বললেও পশ্চিমা দেশে বলে উইগ বা পরচুলা। আগ্রহী ক্রেতাদের কাছে ক্যাপ বিক্রি হয়, আবার নিজেরাই ক্যাপ বানানোর জন্য খুঁজছেন এমন হেয়ার এজেন্টরাও অন্যদের থেকে বাল্ক হিসাবে চুল কেনেন।"
চুলের ওয়ার্কশপের দৃশ্য:
সোহেল ও সিরাজ যেখানে থাকেন তার থেকে কয়েক বিল্ডিং দূরেই রয়েছে ছোটখাট একটি ওয়ার্কশপ। একতলা ও দুই কক্ষের বাড়িটির পথ এবার সিরাজ চেনালেন। প্রবেশপথেই ফটকের কাছে রয়েছে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা। ভেতরে ঢোকা মাত্রই চারপাশ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল এখানে চুলেরই ব্যবসা হয়।
দরজার কাছে ছিল একটি হলুদ বাল্ব বসানো কাচের বাক্স। আরও ছিল ভালোমতো বাছাই করে সাজিয়ে রাখা গোছা গোছা চুলের সাড়ি। সিরাজ বললেন, "এগুলো শুকানো হয়েছে। চুল ওয়াশের পর এভাবে শুকিয়ে রাখা হয়।"
সবেমাত্র ৪০০ বর্গফুট ঘরের ভিতরে আয়তাকারে বসেছিলেন প্রায় ১০ জন পুরুষ; সম্ভবত তাদের বয়স বিশের কোঠায়। তারা চুল প্যাকেজিংয়ে ব্যস্ত। ঘরের অন্য প্রান্তে ছিল একটি বোর্ড, যার চারপাশে প্রায় ছয়জন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের সবার হাতেই একটি করে স্টিমার, যা দিয়ে তারা চুলগুলোকে চাপাচ্ছিলেন (বাষ্পের সাহায্যে)।
"এখানেই ক্যালেন্ডার বোর্ডের ওপর রেখে প্যাকেজিং করা হয়। চুলে স্টিমিং শেষে রাখা হয় কার্ডবোর্ডের বাক্সে। তারপর এই চুল ক্যাপ তৈরিতে ব্যবহার করা যায়," ব্যাখ্যা করলেন সোহেল।
পাশের রুমে প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত চুল বাল্ক আকারে স্তূপ করে রাখা। এসব চুল নিখুঁতভাবে বাছাই সম্পন্ন করে প্রতি গোছার এক প্রান্তে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সোহেল বলেন, "এটা (ওয়ার্কশপ) খুব ছোট একটা ইউনিট। আসল কারখানা আর ওয়ার্কশপগুলো আছে ফায়দাবাদে।
সোহেল ও সিরাজের মাধ্যমে অপর এক হেয়ার এজেন্ট আক্তারের সাথে পরিচয় হলো। তার দেওয়ানবাড়ির ওয়ার্কশপটিতে ফায়দাবাদ বাজার থেকে রিক্সায় যেতে মিনিট ১৫ লাগে।
ব্যবসার ব্যাপারে সিরাজের চেয়েও চাপা স্বভাবের হলেন আক্তার। তার বাড়িও সোহেল আর সিরাজের মতোই। তবে তার ওয়ার্কশপটি বেডরুম সংলগ্ন। আকারেও বেশ বড়। তার শোবার ঘরটি দেখে কন্ট্রোল রুমের কথাই মনে হয়, কাজকর্ম নজরদারিতে একটি মনিটরে ভাসছে বেশ কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার দৃশ্য।
আক্তারের ওয়ার্কশপে আছে একটি কক্ষ, যেখানে বাছাই করা চুল দেওয়ার সাথে হেলান দিয়ে স্তূপ করে রাখা। দেওয়ালে চুলের দৈর্ঘ্যের চিহ্ন রয়েছে, সেই অনুসারেই রাখা হয়েছে। কক্ষটিতে সবচেয়ে কম দৈর্ঘ্যের চুল ছিল ৬ ইঞ্চির।
আপনার উৎপাদন কেমন?- জানতে চাইলে তিনি বলেন, "সব চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। তবে সাধারণত আমরা সপ্তাহে ৩০ কেজি চুল উৎপাদন করি, ঠিক এখানে যতখানি আছে"- কক্ষটির দিকে নির্দেশ করে বললেন।
পুরো বাজার ব্যবস্থাটি এক ঘনিষ্ঠ সম্প্রদায়, সবাই সবাইকে জানে। কে কী উৎপাদন করে সে সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। এই বাণিজ্যে বিভিন্ন দৈর্ঘ্য এবং শৈলীর ক্যাপ প্রস্তুতকারক রয়েছে। কিছু ওয়ার্কশপে এমনকি বিভিন্ন রঙের ক্যাপও তৈরি হয়।
ফায়দাবাদে বিদেশি ক্রেতা:
সিরাজ ও সোহেল জানান, তাদের ৯০ শতাংশ ক্রেতাই হলেন ভিনদেশি। সকাল ৭টা থেকেই তারা বাজারে কেনাকাটা করতে আসেন। বুধবারের ওই দিনে বিকেল বেলাতেও একটি বিদেশি ক্রেতাকে দেখা গেল। তাকে খুব সম্ভবত পরচুলা বা ক্যাপ দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন একজন হেয়ার এজেন্ট।
কয়েক মিনিট চলার পরেই এক সরু গলিপথে অদৃশ্য হন ওই ক্রেতা ও এজেন্ট। খুব সম্ভবত কোনো ওয়ার্কশপে গেলেন কেনাবেচা সারতে। এখানে কেনা চুলই সবশেষে দেশের বাইরে রপ্তানি হবে।
সিরাজ ও সোহেলের মতো আক্তারও দাবি করলেন যে, তার ৯০ শতাংশ ক্রেতাই বিদেশি।
সিরাজ, সোহেল ও আক্তারের মতো ব্যবসায়ীর কারখানা ও ওয়ার্কশপের নিবন্ধন না থাকায় বিদেশিরা এদেশ থেকে কিনে রপ্তানি করতে পারছে, বাড়তি দামের সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু সোহেল বলেন, "আমরা নিবন্ধিত হলে পণ্যের দাম বাড়বে (কারণ তখন সরকারকে কর দিতে হবে) আর তখন ক্রেতাদের হারাব।"
তাই এ ব্যবসা চলে গোপনীয়তা ও একান্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে। "আমরা গণমাধ্যম কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সাথে কথা বলতে দ্বিধা-সংকোচে ভুগি। আপনারা যে চুল হেলায় ফেলে দেন তাকে পুঁজি করেই অনেক শ্রমে আমরা এই ব্যবসা গড়ে তুলেছি।"
সিরাজ ও সোহেল শেরপুর জেলার বেদাতঘরিয়া চুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির মতো কিছু সংগঠনের কমিটিতে থাকার দাবি করেন। তবে তারা এখনও অনিবন্ধিত ব্যবসায়ী এবং সেভাবেই থাকতে চান।
- প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখতে এ প্রতিবেদনে ব্যবসায়ীদের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরিতে সাহায্য করেছেন সাদিকুর রহমান