মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ
- দেশি প্রতিষ্ঠানসহ মোট বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার
- ইতোমধ্যেই কর্মসংস্থান হয়েছে ৮ হাজার লোকের
- পুরো জোন প্রস্তুত হলে মোট ৭০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রত্যাশা, মোট কর্মসংস্থানের আশা ১৬ হাজার
- ৯০ একর জমি নিয়ে শুরু হওয়া প্রকল্প আরও ৩৩ একর বাড়ানো হচ্ছে
- পণ্য উৎপাদন করছে বিদেশি ৪ প্রতিষ্ঠানসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠান
- বিনিয়োগে করতে চায় নেদারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানও
দেশের ১১টি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন (এমআইইজেড) এ সবচেয়ে বেশি, ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান।
জোনের কর্মকর্তাদের মতে, ইতোমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানির ৪টি প্রতিষ্ঠান সেখানে পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে।
এছাড়াও শীঘ্রই উৎপাদনের যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, চীন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে ও ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশসহ ৮টি দেশের মোট ১৪টি প্রতিষ্ঠান এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদন শুরু করেছে।
কর্তৃপক্ষ বলছে আন্তর্জাতিক মানের হওয়ায় এবং পণ্য উৎপাদনের জন্য সব সুবিধা চালু থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে।
এমআইইজেড সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। কর্তৃপক্ষ আশা করছে পুরোপুরি চালু হলে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে মোট ৭০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে। আর কর্মসংস্থান হবে প্রায় ১৬ হাজার মানুষের।
২০১৭ সালের শেষদিকে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা) থেকে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের চূড়ান্ত অনুমোদন পায় মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় ৯০ একর জমির উপর গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি।
বিনিয়োগকারীদের চাহিদার কারনে আরও ৩৩ একর জমি বাড়ানো হচ্ছে। এতে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আকার বেড়ে দাঁড়াবে ১২৩ একর।
মেঘনা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এর সিনিয়র ডিজিএম (অ্যাকাউন্ট) সুমন ভৌমিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইকোনোমিক জোনের জন্য দেওয়া সুবিধাতো আছেই। তার উপর আমাদের এ জোনটি পড়েছে প্রাইম লোকেশনে। ঢাকার কাছে হওয়ায় যোগাযোগের মাধ্যম সহজ, নিজস্ব পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ও গ্যাস সংযোগ রয়েছে। রয়েছে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি)।"
"এছাড়া প্রতিটি ফ্যাক্টরির রাস্তার পাশেই রয়েছে ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ সব ইউটিলিটি ফ্যাসেলিটি ও অন্যান্য সেবা চালু রয়েছে। এসব সুবিধা থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে," বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "সোলার প্যানেল থেকে ২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে এখানে। আরও ১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত করার প্রক্রিয়া রয়েছে। ইকোনমিক জোনে রেইনওয়াটার হারভেস্ট সিস্টেমের কাজও চলছে।"
২০১৮ সালের শেষের দিকে মেঘনা বেভারেজ প্রথম পণ্য উৎপাদন করে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে। বিদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠান প্রথম উৎপাদনে যায়।
ইতোমধ্যেই ফ্যাক্টরি তৈরী করার জন্য প্রায় সব প্লট বরাদ্দ হয়ে গেছে। মাত্র দুই একরের একটি প্লট খালি আছে। তবে বিনিয়োগকারীদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি অংশে আরও ১৪টি প্লট থাকবে।
বিনিয়োগকারী ১২টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান
জার্মানির তিনটি, অস্ট্রেলিয়া, চীন ও জাপানের দুটি এবং সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে ও ভারতের একটি প্রতিষ্ঠান এই অঞ্চলে বিনিয়োগ করেছে।
৭টি দেশের ১২টি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। এ ১২টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে গেলে প্রায় ছয় হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।
২০১৯ সালে উৎপাদন শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠান। তিন একর করে মোট ছয় একর জমিতে টিআইসি ম্যানুফেকচারিং (বাংলাদেশ) লিমিটেড ১২ মিলিয়ন ডলার এবং টিআইসি ইন্ডাস্ট্রি (বাংলাদেশ) ৫.৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে।
এই দুই প্রতিষ্ঠানে প্লাস্টিক গার্মেন্ট হ্যাঙ্গার উৎপাদন করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যপী রিটেইলারদের কাছে রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারকদের কাছে প্লাস্টিকের গার্মেন্টস হ্যাঙ্গার সরবরাহ করে এ প্রতিষ্ঠান দুটি। এছাড়া সরাসরি রপ্তানি করে শ্রীলংকা, চায়না, হংকং, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারতে।
টিআইসি ম্যানুফেকচারিং এর ডিরেক্টর ও কান্ট্রি ম্যানেজার রফিকুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "প্রতিষ্ঠান দুটিতে প্রতিদিন ২ মিলিয়ন হ্যাঙ্গার বানানো হয়, এর শতভাগ এক্সপোর্ট করা হয়। এখন এক হাজার ১০০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। আগামী এক বছর আরও ৫০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠানের এটাই প্রথম বিনিয়োগ।"
প্রিন্টিংয়ে ব্যবহার হওয়া কালি তৈরি করছে জার্মানির সিজরেক বাংলাদেশ লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৭০ জনের। প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগ করেছে ৬.৮ মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে, সিএইচটি বাংলাদেশ লিমিটেড ৪.২৪৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। টেক্সটাইল কেমিক্যাল উৎপাদন করবে এ প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া, এমবি সলিউশনস তৈরি করবে নির্মানকাজের জন্য প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল। দ্রুতই এ দুই প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টরি নির্মান করবে।
জাপানের সাকাতা ইনক্স.লিমিটেড ১০.৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। গত বছরের শেষ থেকে তারা প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং শিল্পের কালি উৎপাদন শুরু করেছে।
কারখানাটিতে কর্মচারী রয়েছেন ২৪০ জন। জাপানের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ডিআইসি বাংলাদেশ লিমিটেড ৩.৪৬৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তারাও কালি ও কেমিক্যাল উৎপাদন করবে।
তবে, সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে চীনের প্রতিষ্ঠান। চীনা মোবাইল ফোন ইসমাতু টেকনোলজি লিমিটেড ১৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। মোবাইল ফোন ও মোবাইলের অ্যাক্সেসোরিজ উৎপাদন করা হবে এ প্রতিষ্ঠানে।
আগামী জুন মাসের মধ্যে ফ্যাক্টরি তৈরীর কাজ শেষ করার পরিকল্পনা তাদের। ৩ হাজার ৪০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে এ প্রতিষ্ঠানে। চীনের আরও একটি প্রতিষ্ঠান এডিভি প্রোসেস কো. লিমিটেড ৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এই প্রতিষ্ঠানটিও কালি উৎপাদন করবে।
সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান সিকা বাংলাদেশ লিমিটেড তৈরী করবে কংক্রিট এবং বিভিন্ন শুকনো মর্টারের জন্য প্রয়োজনীয় মিশ্রণ। ৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে তারা।
ভারতের প্রতিষ্ঠান সান ফার্মাসিউটিকেলস (ইজেড) ১৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তারা বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদন করবে। এ প্রতিষ্ঠানের নির্মান কাজ শুরু হয়েছে। আগামী জুলাইয়ে এ প্রতিষ্ঠানে পণ্য উৎপাদন হবে বলে জানা গেছে।
নরওয়ের প্রতিষ্ঠান জোতুন বাংলাদেশ ৫.০৪৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। দেয়ালে ব্যবহারের বিভিন্ন রং ও কেমিক্যাল উৎপাদন করবে তারা। আগামী জুনে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনে যাবে বলে জানা গেছে।
বিদেশি ১২টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া মেঘনা গ্রুপের মালিকানাধীন আটটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে। এর মধ্যে ৭টি প্রতিষ্ঠান ম্যানুফ্যাকচার ইন্ডাস্ট্রি।
পণ্য উৎপাদন করছে দেশের ১০ প্রতিষ্ঠান
মেঘনা গ্রুপের ৭টি প্রতিষ্ঠানে পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে মেঘনা বেভারেজ লিমিটেডে বেভারেজ ম্যানুফ্যাকচার হয়। অন্যদিকে ইউনিক সিমেন্ট ফাইভার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে সিমেন্ট প্লান্টের ব্যাগ উৎপাদন হয়। এছাড়া, মেঘনা বাল্ক ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজে শতভাগ রপ্তানির জন্য জাম্বু ব্যাগ তৈরী হয়।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিস্কুট, চানাচুর, নুডলস তৈরী হচ্ছে মেঘনা নুডুলস ও বিস্কিট ফ্যাক্টরি লিমিটেডে।
জানা গেছে দেশি আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে। সেগুলো হলো থাই ফয়েলস অ্যান্ড পলিমার, এসটুএস কেমিক্যাল লিমিটেড, মেঘনা স্টার কেবলস অ্যান্ড ইলেকট্রিকাল অ্যাপ্লায়েন্সেস লিমিটেড।
সুমন ভৌমিক বলেন, "নেদারল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠান প্লট নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের ফ্যাক্টরি তৈরীতে ৪ একর জমি প্রয়োজন হবে।" "আমাদের ইকোনোমিক জোনে চাহিদা বেশি হওয়ার জন্য আমরা এখানে আরও জমি বাড়াচ্ছি। বর্তমানে বিদেশি ৪টি ও দেশি ১০টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে। এর মধ্যে মেঘনা গ্রুপের ৭টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে," বলেন তিনি। ফ্যাক্টরিগুলোতে ৮ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিনিয়োগকারীর জন্য সরকার নানা সুবিধা দিচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চলে। রয়েছে বিভিন্ন হারে আয়কর অব্যাহতি, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা, ভূমি উন্নয়ন কর অব্যাহতি।
২০৩০ সালের মধ্যে বেজা সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১০ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করা তাদের লক্ষ্য।