স্থানীয় এজেন্টরা অন্যত্র বিক্রি করায় অর্ডার দেওয়া তুলার সরবরাহ পাচ্ছে না স্পিনিং মিলগুলো
কন্টেইনার সংকটের কারণে সরবরাহে দেরির অজুহাত দেখিয়ে তুলার আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের (এজেন্ট) একটি অংশ অসৎ পন্থা অবলম্বন করছে। প্রকৃত আমদানিকারক যাদের সাথে তাদের বিক্রয় চুক্তি রয়েছে তাদের ফাঁকি দিয়ে বেশি দামে অন্যদের কাছে তুলা বিক্রি করছে তারা।
বিক্রয় চুক্তি বা সেলস কন্ট্রাক্ট- ক্রেতা ও বিক্রেতার ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে হয়। এর মাধ্যমে বিক্রেতা একটি নির্দিষ্ট দামে ক্রেতার কাছে কোনো কিছু বিক্রি বা সরবরাহের ব্যাপারে সম্মতি দেয়। চুক্তিতে উল্লেখ থাকায়; পরে দাম বেড়ে গেলেও বিক্রেতা তাই বাড়তি মূল্য দাবি করতে পারে না।
কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত আটজন স্থানীয় এজেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা নিজেরা 'বাণিজ্যিকভাবে লাভবান' হওয়ার জন্য আমদানিকারকদের না জানিয়ে বিক্রয় চুক্তি অন্য পক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিক্রয়ের এমন অনিয়ম তুলার সংকট তীব্র করে তুলেছে।
ফলস্বরূপ; এলসি খোলার পরও কিছু স্থানীয় এজেন্টের সরবরাহের দেরির কারণে স্থানীয় স্পিনিং মিলগুলো তুলা সংকটে পড়েছে। মিলগুলো এসব এজেন্টদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সরবরাহকদের কাছে তুলা আমদানির কার্যাদেশ দিয়েছিল। অথচ এসব এজেন্ট পোশাক প্রস্তুতের গুরুত্বপূর্ণ এই কাঁচামাল অন্যদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
বেশ কয়েকজন স্পিনার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন যে, সময়সীমা শেষ হওয়ার পর ৩-৪ মাস পার হয়ে গেলেও তারা তুলার চালান পাচ্ছেন না। তারা এখন আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতি সামাল দিতে কোনো কোনো স্পিনিং মিলকে বাড়তি দামে স্থানীয়ভাবে তুলা কিনতে হচ্ছে। অথচ ছয় মাস আগের .৯৫ সেন্ট মূল্যের প্রতিপাউন্ড তুলার দর বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১.৬৫ ডলারে।
এ পরিস্থিতিতে নিজেদের উদ্বেগ জানিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কটন অ্যাসোসিয়েশন- আইসিএ'কে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) চিঠি পাঠিয়ে দরকারি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
চিঠির জবাবে আইসিএ'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিল কিংডন বলেছেন, "মার্চেন্টরা জাহাজে পণ্য আসায় দেরির দোহাই দিয়েছে বাণিজ্যিক সুবিধা নিচ্ছে, এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি সকল পক্ষের জন্যই হতাশাজনক।"
বিটিএমএ- এর সহ-সভাপতি এবং ইশরাক টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক টিবিএসকে বলেন, "গত মার্চে আমার ১৬ হাজার টন তুলা বন্দরে আসার কথা ছিল। কিন্তু সরবরাহকারী মাত্র এক হাজার টন পাঠিয়েছে। যদিও আমার প্রতি মাসে চার হাজার টন প্রয়োজন। দেশে এখন তীব্র তুলা সংকট।"
বাংলাদেশ প্রধানত লুই ড্রেফাস কোম্পানি, ওলাম ইন্টারন্যাশনাল এবং কারগিল কটন থেকে তুলা আমদানি করে।
চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণে মঙ্গলবার রাজধানীর বিটিএমএ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে একাধিক সদস্য বলেছেন, আইসিএ'র কিছু নিয়ম বাংলাদেশি আমদানিকারকদের স্বার্থ রক্ষা করে না।
উদাহরণস্বরূপ, যদি ক্রেতা এবং সরবরাহকারীদের মধ্যে কোন বিরোধ থাকে; তাহলে ক্রেতাদের আইসিএ ব্যতীত অন্য কোনও পক্ষের কাছে অভিযোগ দায়ের করার নিয়ম নেই সংস্থাটির।
তাই বিটিএমএ আলাদা নীতিমালা করার কথা ভাবছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান স্থানীয় স্পিনিং, ওয়েভিং, ডাইং ও প্রিন্টিং মিলসের উন্নয়ন বিষয়ক বিটিএমএ স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মো. খোরশেদ আলম।
আমদানিকারকদের সরবরাহ না করে স্থানীয় এজেন্টদের অন্য কোম্পানির কাছে তুলা বিক্রি করার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। সম্প্রতি এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন দেশের নামকরা একজন স্পিনিং মিল মালিক (স্পিনার)।
নাম না প্রকাশের অনুরোধ করে, ওই কারখানা মালিক টিবিএসকে জানান, তার প্রতিপাউন্ড ৯৩ সেন্টে তুলা সংগ্রহের চুক্তি ছিল, কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ার পর এজেন্ট তা অন্যত্র বিক্রি করে দেয়।
এ ঘটনা ধরা পড়ার পর ওই এজেন্ট তার দায় স্বীকার করে, প্রায় আট লাখ মার্কিন ডলার জরিমানা দিতে সম্মত হয়।
অভিযুক্ত ওই স্থানীয় এজেন্টের সঙ্গে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে, অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি এজন্য কন্টেইনার সংকট এবং চট্টগ্রাম বন্দরে শিপিং কোম্পানিগুলোর জাহাজ আসতে না চাওয়াকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, এজেন্ট চাইলেই এভাবে কারো কটন বিক্রি করে দিতে পারে না।
তাহলে তিনি জরিমানা দিতে কেন রাজি হলেন?- এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। বরং তিনি তার ও প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান এ প্রতিবেদককে।
টেক্সটাইল মিল মালিকরা জানান, আমদানিকারকদের অর্ডার করা তুলা অন্য পক্ষের কাছে বিক্রির অভিযোগে ইতোমধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরেকজন জেল খাটছে।
এ ধরনের প্রায় ৮-১০টি অনিয়ম পাওয়া গেছে বলেও জানান তারা। এবং যারা জড়িত তারা বাংলাদেশ কটন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য নয়।
তাদের কালো তালিকাভুক্ত করার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা- জানতে চাইলে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন টিবিএসকে বলেন, "আমরা এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান বিধিবিধান পর্যালোচনা করছি।"
বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৯০ লাখ বেল তুলা আমদানি করে, এতে বার্ষিক চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ হয়। দেশে বিটিএমএ'র সদস্যভুক্ত টেক্সটাইল মিল দেড় হাজারের বেশি, যার মধ্যে ৪৩৩টি হলো সুতার স্পিনিং মিল।
তুলা উৎপাদন ৮.৪ শতাংশ বাড়ার পূর্বাভাস বিশ্বব্যাংকের:
গত মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংকের কমোডিটি বাজারের আপডেট প্রকাশিত হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুই তুলা রপ্তানিকারক ব্রাজিল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশে ২০ শতাংশ হারে তুলা উৎপাদন বাড়বে বলে সেখানে জানানো হয়। এতে তুলার বৈশ্বিক উৎপাদন বাড়বে ৮.৪ শতাংশ। তবে বিশ্বের অপর দুই বৃহৎ উৎপাদক- চীন ও ভারতে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন সামান্য কমার শঙ্কা রয়েছে। ২০২২ সাল জুড়ে তুলার দাম ৪০ শতাংশ বেশি থাকার অনুমান করেছে বিশ্বব্যাংক, বিরূপ আবহাওয়ার বাধা দূর হলে ২০২৩ সালে দাম ৬ শতাংশে নেমে আসবে।
তুলার দামে বর্তমানে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে, যা শুরু হয় ২০২০ সালের মে মাসের শুরুতে। মার্চে তুলার দাম ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। গত ২৩ মাসের মধ্যে আবার দাম বৃদ্ধি হয়েছে ২০ মাসেই।