বেড়েই চলেছে ভোগ্যপণ্যের দাম
বেড়েই চলেছে ভোগ্যপণ্যের দাম। পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে রমজানের পর বেশ কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগে গত আড়াই মাস ধরে বেড়ে চলেছে প্রতিটি পণ্যের দাম। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভোজ্যতেল, গম, ডাল, সরিষাসহ আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের দাম। করোনা পরবর্তী সময়ে সরবরাহ সংকট ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাপ্লাই চেন ব্যাহত হওয়ায় ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে বলে মন্তব্য আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের।
খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী মেসার্স ইসহাক সওদাগরের স্বত্বাধিকারী সেকান্দার হোসেন বলেন, রমজানের পর গত দুই-তিন দিনে কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম আরো এক দফা বেড়েছে। এর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আমদানিকারকদের কাছ থেকে প্রত্যেকবার নতুন চালানের ভোগ্যপণ্য কিনতে বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে। ফলে আমরাও বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।
এই ব্যবসায়ী বলেন, কোন পণ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে ১০ শতাংশ দাম বাড়লে আমদানিকারকরা সিন্ডিকেট করে দেশীয় বাজারে একই পণ্যে ২০ শতাংশ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে বাজারে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে এই সময়ে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যে প্রায় ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী।
ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী জানান, করোনার প্রভাবে গত এক-দেড় বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। এরমধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ভোগ্যপণ্যের বাজারে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। ভোজ্যতেল, গম, ভুট্টা, সরিষা ও ডালজাতীয় সব পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় থেকে গত আড়াই মাসে প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের বুকিং দর কমপক্ষে ১০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এতে দেশীয় বাজারেও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে চলেছে।
ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত আড়াই মাসে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে ভোজ্যতেল, গম, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম। এই সময়ের মধ্যে দেশের বাজারে মণে (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ২৯০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বর্তমানে গম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। যা যুদ্ধের আগের দিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৬০ টাকা দামে।
একই সময়ে মণে (৪০ দশমিক ৯০ লিটার) ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বর্তমানে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার ৫০০ টাকায়। যা যুদ্ধের আগে ৬ হাজার ৩০০ টাকা দামে বিক্রি হতো।
যুদ্ধের আগে বাজারে পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৩০০ টাকা দামে। মণে ১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বর্তমানে পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার টাকায়।
শুধু গম এবং ভোজ্যতেল নয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর গত আড়াই মাসে বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।
গত আড়াই মাসে পাইকারিতে প্রতিমণ চিনির দাম ১৯০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে বাজারে প্রতিমণ চিনি বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৬৪০ টাকা দামে। যা এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮৩০ টাকায়।
একই সময়ে ৭৪৭ টাকা বেড়ে বর্তমানে প্রতি মণ সাদা মটর বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৪০ টাকায়।
এই সময়ে মসুরের দাম মণে ৪৮৪ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়ে বাজারে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানিকৃত মসুর বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪৭০ টাকা দরে।
এই সময়ে ইউক্রেন থেকে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্য সরিষার দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক। আড়াই মাস আগে প্রতি মণ সরিষা ২ হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি হলে মণে ১ হাজার ৩৪ টাকা বেড়ে এখন সরিষা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৯৯৩ টাকায়।
একই সময়ে মণে প্রায় ৪৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত ভুট্টার দাম। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে প্রতি মণ ভুট্টা ১ হাজার ১২০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকায়।
গত আড়াই মাসে প্রতি মণ খোসা ছাড়া চীনাবাদামের দাম ৭৮৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৪৫০ টাকা দামে। ১ হাজার ৪৪ টাকা দাম বেড়ে বর্তমানে ভারতীয় জিরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ১৪ হাজার ১০০ টাকা দামে।
ভোগ্যপণ্যের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক (অপারেশন) তারিক আহমেদ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের ভোগ্যপণ্যের বাজারে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গম, ভুট্টা ও সরিষা আমদানি বন্ধ রয়েছে। সরবরাহ সংকটে পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। তাছাড়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনও বিঘ্ন হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে দেশীয় বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে।
ঊর্ধ্বমুখী বাজার সম্পর্কে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন সংকটের কারণে পণ্যের দাম একদফা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপর জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির। এরমধ্যে ডলারের দাম বেড়েছে। এসবের সাথে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে গত আড়াই মাস ধরে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে প্রায় প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ না হলে খুব শিগগিরই পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনাও কম বলে মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।