গরমে ঠান্ডা ঠান্ডা আইসক্রিমের রমরমা ব্যবসা
করোনার কবলে পড়া দুই বছরে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের অন্যতম হলো আইসক্রিম। আগের বছরগুলোতে এ খাতে প্রতি বছর প্রায় ১৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছিলো কিন্তু করোনার কারণে এই হার প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। তবে চলতি বছর রমজান ও ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে আবারও জমে উঠেছে দেশের আইসক্রিমের বাজার। গত দেড়মাসে প্রায় দুইশত কোটি টাকার ব্যবসা করেছে দেশের আইসক্রিম শিল্প; বাজারের এই উত্থানে সুদিন দেখছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে দেশে আইসক্রিমের বাজারের আকার ছিল ৭৩০ কোটি টাকার। ২০২১ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪০০ কোটি টাকায়। বছরের ব্যবধানে ব্যবসা বেড়েছে ৯৩ শতাংশের বেশি।
চলতি বছর কমপক্ষে ১৫০০ কোটি টাকা ব্যবসার আশা করা হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে, ২০২৫ সালের মধ্যে বাজারের আকার ২৬০০ কোটি টাকায় পৌঁছতে পারে। করোনা মহামারির আগে, ২০১৯ সালে আইসক্রিমের বাজারের আকার ছিল ১২৪০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে এ বাজারের আকার ছিলো ১০০০ কোটি টাকার।
দেশের আইসক্রিমের বাজারে সবচেয়ে বড় কোম্পানি আব্দুল মোনেম লিমিটেডের মালিকানাধীন ইগলু। কোম্পানিটির সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার সুমিত চক্রবর্তী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মহামারির কারণে যে ক্ষতি হয়েছিলো তা পুষিয়ে নিয়ে এখন ভালো ব্যবসা হচ্ছে। আবহাওয়া ও ঈদের আমেজের মাঝে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে এ খাত এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে চলতি বছরের বিক্রি অন্য বছরের চেয়ে বাড়বে।'
চট্টগ্রামের ব্র্যান্ড কোয়ালিটি আইসক্রিম। প্রতিষ্ঠানটির ন্যাশনাল সেলস ম্যানেজার মাহমুদুল হক পাটোয়ারী বলেন, 'এবারের ঈদে প্রতিটি কোম্পানি তাদের পণ্য সরবরাহে হিমশিম খেয়েছে। আমাদের অনেক প্রোডাক্ট কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারিনি। গত এপ্রিল ও মে মাসের প্রথম দশ দিন দেশের আইসক্রিম শিল্প নতুন জীবন পেয়েছে।'
একটি আইসক্রিম কোম্পানির প্রতিবেদন অনুসারে, কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই দেশীয় ব্র্যান্ডেড আইসক্রিম কোম্পানিগুলোর মধ্যে ইগলু শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। তারা বাজারের চাহিদার ৪৩ শতাংশ আইসক্রিম সরবরাহ করেন। দ্বিতীয় অবস্থান পোলারের। কোম্পানিটির মার্কেট শেয়ার রয়েছে ২১ শতাংশ। ১৩ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে চট্টগ্রামের কোয়ালিটি রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে, ব্লুপ মার্কেটের ৮ শতাংশ শেয়ার নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। বেলিসিমো এবং জা-এন-জি ৭ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে এবং লাভেলো ৫ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে।
বাকি ৩ শতাংশ মার্কেট শেয়ার আঞ্চলিক আইসক্রিম প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর। আঞ্চলিকভাবে জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রামের পান্ডা, মাগুরার পিপাসা আইসক্রিম ও খুলনার মিল্কি ইত্যাদি।
গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা সাজ্জাদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আইসক্রিম একটি মুখরোচক খাবার। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আর্থিক অবস্থান ও গরমের সাথে এই পণ্যটি বিক্রির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু বর্তমানে দেশে তীব্র গরম ও ঈদ উৎসব চলছে, সে কারণে আইসক্রিমের বাজার এখন যে কোনো সময়ের চাইতে ভালো অবস্থায় আছে।'
'বাংলাদেশের আইসক্রিম শিল্পে বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পে ১০ হাজার মানুষ কর্মরত রয়েছেন। দেশের আঠারো কোটি মানুষের প্রতি ১০০ জনে একজনও যদি প্রতিদিন একটি করে আইসক্রিম খায়, সেই চাহিদা পূরণের সক্ষমতা দেশের আইসক্রিম কোম্পানিগুলোর নেই। তাই এই শিল্পে এখনো বড় আকারের বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে,' যোগ করেন সাজ্জাদুর রহমান।
লংকাবাংলা গ্রুপের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার আগে দেশের জিডিপিতে আইসক্রিম শিল্পের অবদান ছিল ০.০৬৪ শতাংশ। এ হার প্রতিবেশি দেশ ভারতের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ভারতের জিডিপিতে এ খাতের অবদান ০.০৩১ শতাংশ। তবে এশিয়ার আরেক দেশ ভিয়েতনাম বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। দেশটির জিডিপিতে আইসক্রিম শিল্পের অবদান ০.০৯৪ শতাংশ। সারাবিশ্বের জিডিপিতে এর অবদান শূন্য দশমিক শূন্য ৫৩ শতাংশ।
কোয়ালিটি আইসক্রিমের প্রতিষ্ঠানটির ন্যাশনাল সেলস ম্যানেজার মাহমুদুল হক পাটোয়ারী বলেন, 'আইসক্রিমে ১২ শতাংশ থাকে মিল্ক ফ্যাট। আইসক্রিম তৈরির প্রধান এ কাঁচামাল আমদানি করতে হয় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, স্পেন, ডেনমার্ক, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে। এ অবস্থায় শিল্পের সম্প্রসারণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কাঁচামালে আমদানি শুল্ক। কাঁচামালে সর্বনিম্ন ৩৭ থেকে সর্বোচ্চ ১২৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। আইসক্রিম সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ফ্রিজ আমদানিতেও বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। শিল্পের সম্প্রসারণের জন্য এসব শুল্ক কমিয়ে আনা প্রয়োজন।'