ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির মধ্যেও অর্থ সরবরাহ ১৫ শতাংশ বাড়াতে চায় সরকার
বাড়তি মূল্যস্ফীতির মধ্যেই মুদ্রা সরবরাহ ব্যাপক হারে বাড়াতে চাইছে সরকার। নতুন অর্থবছরে ব্রড মানির পরিমাণ ১৫.৪ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। মুদ্রা সরবরাহে প্রবৃদ্ধির এ হার সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বেহিসাবি মুদ্রা সরবরাহ সার্বিক মূল্যস্ফতিকে উষ্কে দিতে পারে বলে আশঙ্কা কারছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সীমার মধ্যে রেখে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে আগামীতে মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনতে হবে।
ব্রড মানি বা 'এম টু' হলো অর্থ সরবরাহের একটি গণনা যাতে নগদ এবং চেকিং ডিপোজিটের মতো ন্যারো মানির সব উপাদান যেমন ক্যাশ এবং চেক ডিপোজিট ছাড়াও সঞ্চয় আমানত, মানি মার্কেট সিকিউরিটিজ এবং অন্যান্য আমানত অন্তর্ভুক্ত।
এম টু হলো অর্থ সরবরাহের একটি বিস্তারিত পরিমাপ। অর্থ সরবরাহ এবং ভবিষ্যতের মুদ্রাস্ফীতির একটি সূচক হিসেবে এটিকে ধরা হয়। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের মুদ্রানীতির লক্ষ্য হিসেবেও ধরা হয় একে।
গত অর্থবছরে ব্রড মানির পরিমাণ বেড়েছিল ১৩.৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মুদ্রা নীতিতে ব্রড মানি ১৩.৮ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য থাকলেও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ৯.৪৬ শতাংশ। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে এ লক্ষ্য ১৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।
টাকার অঙ্কে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আর্থিক প্রবৃদ্ধির চাইতে মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি বেশি হলে পণ্যের দাম আরেক দফায় বাড়বে। আর নতুন এই মূল্যস্ফীতির চাপে বেকায়দায় পড়বে দরিদ্র ও নির্ধারিত বেতনের চাকুরিজীবীরা।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভায় অর্থমন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। আর এ সময়ের গড় মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫.৬ শতাংশ।
প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি মিলে টাকার অঙ্কে জিডিপি বাড়বে ১৩.১ শতাংশ। এ হিসাবে বাজারের চাহিদার চাইতে মুদ্রা সরবরাহে ২.৩ শতাংশ বাড়তি প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে এই মূহূর্তে মুদ্রা সরবরাহের লাগাম টেনে ধরতে হবে। অবাধ অর্থ প্রবাহ বাড়লে আগামীতে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার চাহিদা বেড়ে গিয়ে দাম বেড়ে যাবে। তাছাড়া চাহিদা বাড়লে আমদানির পরিমাণ বেড়ে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও মুদ্রার বিনিময় হারে চাপ পড়বে।"
তিনি আরও বলেন, "অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পুজির প্রয়োজন মেটাতে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তবে এই মূহূর্তে প্রবৃদ্ধির চাইতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার সুরক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।"
বড় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছুটা কমপ্রোমাইজ করে মুদ্রা সরবরাহে নিয়ন্ত্রণ আরোপের পক্ষে মত দিয়ে প্রবৃদ্ধি কমে আসায় ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষদের জন্য সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো পরামর্শ দেন এ অর্থনতিবিদ।
ব্যাপক মুদ্রার (এম টু) প্রবৃদ্ধির নতুন লক্ষ্যমাত্রাকে বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে বিআইডএস এর গবেষণা পরিচালক ড. মনজুর হোসেন বলেন, "যেকোনো মূল্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ আগামী বাজেটে থাকতে হবে। এই অগ্রাধিকারের সঙ্গে মুদ্রা সরবরাহের সিদ্ধান্তের কনফ্লিক্ট আছে।"
বিশ্বব্যাপী অর্থের সরবরাহ কমলে পণ্যের চাহিদা কমে আসে। এর ফলে দামও নিয়ন্ত্রণে আসে।
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই রেপো রেটের হার বাড়িয়েছে। আগামীতে এটা আরও বাড়তে পারে। এ অবস্থায় নতুন করে বাড়তি মূদ্রা সরবরাহের কোন যৌক্তিকতা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ব্যাপক মূদ্রা ১৬.৭ শতাংশ বৃদ্ধির পরের বছর প্রবৃদ্ধি ১৩.৭ শতাংশে নেমে আসে। সর্বশেষ গত অর্থবছর এতে প্রবৃদ্ধি হয় ১৩.৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছর মুদ্রানীতিতে ১৩.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্জন দাঁড়ায় ৯.৪৬ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে এ লক্ষ্য ১৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ ১৬ শতাংশে উন্নীত করতে মুদ্রা সরবরাহের নতুন লক্ষ্য ঠিক করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হলেও মূলত সরকারের বাড়তি ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন মেটাতে এ লক্ষ্য ১৭.৮ শতাংশে উন্নীত করা হচ্ছে।
নতুন বাজেটে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ১৫ শতাংশ। গত কয়েক বছর ধরে এ খাতে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলণ করা হলেও অর্জন থাকছে ৮ শতাংশের মধ্যে। অবশ্য চলতি বছরের এপ্রিলে বেসরকারি খাতের ঋণে তিন বছরের সর্বোচ্চ ১২.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির খাত চিহ্ণিত করে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ঠিক রাখতে পারলে নতুন মূদ্রার সরবরাহ খুব একটা ঝুঁকি সৃষ্টি করবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নন ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, "অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতি যেমন আছে, সরবরাহ সংকটের কারণেও মূল্যস্ফীতি আছে। বেসরকারি পর্যায়ের সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারলে পণ্যের উৎপাদন যেমন বাড়বে, উৎপাদনের খরচও তেমন কমবে। এর ফলে পণ্যের দাম কমে মূল্যস্ফীতি কমবে, মানুষের আয়ও বাড়বে।"
তবে শুধু অর্থের অবাদ প্রবাহ বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে খুব একটা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, "ব্যবসা শুরু থেকে পরিচালণার প্রতিটি পর্যায়েই বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি ও চাদাবাজির মত সমস্যাগুলোর সমাধান করা হলে অর্থের প্রবাহ বিনিয়োগ বৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। আর এটা করা না গেলে নতুন মুদ্রা শুধু মূল্যস্ফীতিই বাড়াবে।"
অবশ্য কো-অর্ডিনেশান কাউন্সিলের সভায় অর্থ বিভাগের সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, বাংলাদেশে ব্যাপক মুদ্রার (এম টু) পরিমাণ খুবই কম। কয়েক বছর ধরে বাড়লেও এখনও তা জিডিপির ৭০ শতাংশের নিচে। প্রতিবেশী ভারতে ব্যাপক মুদ্রা জিডিপির ৭০ শতাংশের কাছাকাছি। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশে তা আরও বেশি।
এম টু সরবরাহ বাড়ানো গেলে বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের অর্থায়ন বাড়ানো যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন।