আফগানিস্তানে পরিস্থিতির এত দ্রুত অবনতির কারণ কী?
এটাই কী আফগানিস্তানের ভিয়েতনাম মুহূর্ত?
বিদেশি সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়া মাত্রই একের পর এক বড় শহরের দখল নিচ্ছে তালেবান। আর গ্রামীণ জনপদের সিংহভাগ এরমধ্যেই তাদের নিয়ন্ত্রণে। প্রশ্ন জাগছে, ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করার পর রাতারাতি যেভাবে সমাজতন্ত্রী সরকার পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল, তালেবান সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করতে চলেছে কিনা?
বাস্তবতাও দিচ্ছে তেমনই ইঙ্গিত। কট্টর ইসলামপন্থী তালেবান সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীকে একের পর এক লড়াইয়ে চোখের পলকে পরাস্ত করছে যেন, তাদের বিস্ময়কর সম্মুখ অভিযানের সর্বশেষ খবর আপডেট রাখতে হিমশিম খাচ্ছে গণমাধ্যমগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে শান্তি আলোচনার তাগিদ দিয়ে বলছেন, তালেবান এ পথে না হেঁটে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পুরো দেশ দখল করলে তাদের আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেবে ওয়াশিংটন।
তবে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সাবেক ও বর্তমান মার্কিন কর্মকর্তারা অবশ্য বিস্মিত। তালেবানের বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে অগ্রসর হওয়ার ঘটনা তারা নেপথ্যে স্বীকার করে বলেছেন, শান্তি আলোচনার সকল আশা মুছে গেছে।
মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের সর্বশেষ এক পর্যালোচনা সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় রাজধানী কাবুলের পতন হতে পারে ৯০ দিনের মধ্যে। এর আগে কাবুল ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে বলে আশা করেছিলেন মার্কিন গোয়েন্দারা। তবে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে সে আশা যা আকাশকুসুম ছিল- সেটাও মেনে নিলেন তাঁরা।
এরমধ্যেই ১৬ থেকে ১৭টি প্রাদেশিক রাজধানী তালেবানের দখলে চলে গেছে। আগামী দিনগুলোতে কাবুলে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের কর্মী সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। সাময়িকভাবে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে তিন হাজার মার্কিন সেনা, তারা কূটনৈতিক কর্মী কমানোর তদারকি করবেন, আর গুরুতর বিপদ বুঝলে সকল মার্কিন নাগরিক প্রত্যাহারেও সাহায্য করবে।
এই দৃশ্যপট যেন ভিয়েতনামের কথাই মনে করে দেয়, যখন শেষ মুহূর্তে হেলিকপ্টারে করে মার্কিনীদের পালাতে হয়েছিল। সত্যি বলতে এমন তুলনার প্রাসঙ্গিকতা অস্বস্তিকর হলেও বাস্তব।
মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০ বছর ধরে যুদ্ধ পরিচালনা ও আফগানিস্তান পুনর্গঠনে দুই লাখ কোটি ডলার খরচ যেন ধোঁয়ায় উবে যেতে চলেছে। আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ নিয়ে আগামী দিনগুলোতে অনেক শবচ্ছেদই হবে, যার সব দিক এখানে তুলে ধরাও সম্ভব নয়। তার পরিবর্তে আমরা সাবেক ও বর্তমানে দায়িত্বরত কিছু মার্কিন ও আফগান কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞের দেওয়া সাক্ষাতকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরতে পারি; এর মাধ্যমে পরিস্থিতির নাটকীয় গতিতে অবনতি সম্পর্কে পাঠক একটি স্বচ্ছ ধারণা পাবেন।
গেল মার্চে রিপাবলিকান দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন আইনপ্রণেতা স্টিফেন লিঞ্চ ফরেন পলিসি'কে বলেছিলেন, তালেবানের মতোই দুর্নীতিও আফগান সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় এক হুমকি। যুদ্ধক্ষেত্রে এই সমস্যার বাস্তব প্রতিফলনও আজ আমরা লক্ষ্য করছি।
চলতি সপ্তাহে ফরেন পলিসির প্রতিবেদক লিন ও'ডনেল কাবুল থেকে রিপোর্ট করেন, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সর্বস্তরে আফগান প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর অযোগ্যতা ও নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থকেই প্রাধান্য দেন কর্মকর্তারা। এসব অনুঘটকের কারণেই যুদ্ধের ময়দানে সরকারি বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটছে বলে উল্লেখ করেছেন তারা।
এব্যাপারে দুটি উদাহরণ তুলে ধরেন লিন ও'ডনেল। তিনি জানান, যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের অতি-দরকারি রসদ ও গোলাবারুদ তাদের হাতে পৌঁছানোর আগে সেখান থেকে চুরি করেছেন সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। অন্যদিকে, বহু সেনা কয়েক মাস ধরে বেতনই পাননি।
বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেছেন যে, নিয়মিত স্থল সেনাদের প্রতিরোধ যখন তালেবান আগ্রাসনের মুখে কর্পুরের মতো উবে যাচ্ছে, তখন কেবলমাত্র সফল প্রত্যাঘাত হানতে পারছে আফগান বিমান বাহিনী ও স্পেশাল ফোর্স। তাদের তৎপরতার কারণেই নিয়মিত সেনাদের পিছু হটা সম্পূর্ণ বিপর্যয়ে রূপ নেয়নি এখনও।
কিন্তু, বিমান বাহিনীর সক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গত মাসে সাংবাদিকদের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বেশ কয়েকজন আফগান আইনপ্রণেতা বিমান বাহিনীকে আরও যুদ্ধবিমান অনুদান দেওয়ার জন্য রীতিমতো অনুনয় করেছিলেন। তারা বলেন, আফগান বিমান বাহিনীর কাছে ১৬০টি বিমান (হেলিকপ্টার-সহ) থাকলেও এর এক-তৃতীয়াংশ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এজন্য বিমান রক্ষণাবেক্ষণে পেন্টাগন নির্ধারিত ঠিকাদার সংস্থাগুলো বহুলাংশে দায়ী বলেও জানান।
হেরাত থেকে নির্বাচিত এক আইনপ্রণেতা নাহিদ ফরিদ এসময় বলেছিলেন, "এসব বিমান যদি উড়তেই না পারে এবং তালেবান যোদ্ধাদের জমায়েত লক্ষ্য করে হামলা চালাতে না পারে; তআহলে তালেবান আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং শহরগুলো ঝটিকা আক্রমণে দখল করে নেবে। তখন বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।" ভবিষ্যৎবাণী সত্যি করে বৃহস্পতিবার আফগানিস্তানের তৃতীয় বড় শহর হেরাতের দখল নেয় তালেবান।
নিরাপত্তা ঠিকাদারদের আফগানিস্তান ত্যাগও মূল সমস্যা। এ ধরনের ঠিকাদাররা আসলে ভাড়াটে কর্মী ও যোদ্ধা। আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর যুদ্ধকৌশলের মূল অংশ ছিল ভাড়াটে যোদ্ধা ও নিরাপত্তা ঠিকাদাররা। তবে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের সাথে সাথে হাজার হাজার ঠিকাদার ফিরে গেছে। এসব কর্মী সংবাদ শিরোনামের নেপথ্যে রয়ে গেলেও তারা আফগান বাহিনীর সরবরাহ চক্র অটুট রাখাসহ, প্রশিক্ষণ, সমরাস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। তাদের অনুপস্থিতি এসব কার্যক্রমকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যাহত করছে।
#তালেবানের সঙ্গে দর কষাকষিতে শেষ সুবিধার জায়গাটিও হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জোর করে ক্ষমতা দখল করলে তালেবানকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করে ফেলার হুমকি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দুর্বল হলেও এই হুমকি একেবারে অবান্তর নয়; কারণ তালেবান এখন বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাঁরা আঞ্চলিক শক্তিসমূহের সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা করেছে এবং তাদেরকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে। এভাবে গোষ্ঠীটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি বৈধ শক্তি বা কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চাইছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি কিছুটা কাজেও দিতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশেষজ্ঞ ফরেন পলিসির সিটরেপ শাখাকে বলেন, " যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এই ইস্যুতে অধিক গুরুত্ব দেওয়া মোটেও আশ্চর্যজনক নয়। কারণ, এটাই মার্কিন প্রশাসনের হাতে থাকা একমাত্র চাপ প্রয়োগের উপায়। তবে এটি উদ্দেশ্যসাধনের উপযুক্ত শক্তি হতে পারবে বলে আমি প্রত্যাশা করি না, কারণ তালেবান যে উদ্দেশ্যে লড়াই করছে এবং যেজন্য লড়ছে- তার প্রধান উদ্দেশ্যই ক্ষমতা দখল।
বলপ্রয়োগের পথে চলে তালেবান ক্ষমতায় আসলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তালেবান নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, বন্ধ করতে পারে আফগানিস্তানকে দেওয়া সহায়তাও। তবে ফরেন পলিসির সঙ্গে আলোচনাকারী প্রায় সকল বিশেষজ্ঞি একমত যে, সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমেও তালেবানকে আগ্রাসন বন্ধে বাধ্য করা যাবে না। আর এই মুহূর্তে সে সুযোগও অত্যন্ত কম, কারণ তারা অগ্রগতি করছে।
আফগানিস্তানে পুনরায় হস্তক্ষেপে বহিঃশক্তির প্রভাবকেও মাপতে হচ্ছে মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের। সবকিছু বুঝশুনেই তারা আফগানিস্তান থেকে সরে আসার কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেন।
যেমন; ওয়াশিংটনের চোখের বালি দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়া উত্তরপশ্চিম চীনে এক যৌথ মহড়ার আয়োজন করছে। মহড়ায় অংশ নেবে দুই দেশের ১০ হাজার সৈনিক। প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে, এটি তাদের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কৌশল উন্নয়ন ও নতুন সমরাস্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষার অংশ। তবে অধিকাংশ সামরিক মহড়ার মতো এটিরও মূল উদ্দেশ্য হলো; শক্তি প্রদর্শন এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি সামর্থ্যের বার্তা পাঠানো। মস্কো ও বেইজিংয়ের গলায় গলায় দোস্তি না থাকলেও- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা সামরিক সম্পৃক্ততা জোরদার করেছে।
#আরও বলা যাক ইরানের নতুন সরকারের প্রসঙ্গ। তারাও পশ্চিমা প্রভাব-প্রতিপত্তির বিরোধী। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি কট্টর পসচিমা-বিরোধী হিসেবে পরিচিত একজন কূটনীতিক হুসেইন আমিরদৌলাহিন'কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল আহমেদ ভাহিদি'কে। যিনি কিনা ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অভিজাত শাখা কুদস ফোর্সের প্রধান ছিলেন ১৯৯৪ সালে আর্জেন্টিনায় জিউস সেন্টারে হামলার সময়ে। ওই হামলায় ৮৫ জনের প্রাণহানি হয়, আহত হয় শতাধিক। এই হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে এখনও তিনি ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড লিস্টে রয়েছেন।
এ ঘটনা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, রইসি যুক্তরাষ্ট্রকে গ্রাহ্য করেন না এবং ঘরের কাছে আফগানিস্তানে মার্কিন স্বার্থে আঘাত হানতেও দ্বিধা করবেন না। আর সাম্প্রতিক সময়ে তেহরানের সঙ্গে তালেবানের সহযোগিতার ঘটনাতেও উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট উপকরণ ছিল মার্কিন জেনারেলদের।
লেখক: রবি গ্র্যামার- ফরেন পলিসির কূটনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদক
- সূত্র: ফরেন পলিসি