ইরানে সংস্কার সম্ভাবনার সর্বনাশ ঘটিয়ে গেছেন ট্রাম্প, দেশটির নতুন কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্টই তার জ্বলন্ত প্রমাণ
ইরানিদের জন্য এটি হওয়ার কথা ছিল বাসন্তী উৎসবের দিন। তেহরানের বুলেভার্দগুলোর সারসার গাছে সূর্যের আলো ঝকমক করছিল। ঝিরঝিরে বাতাস আদুরে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল শহরের গায়ে। কিন্তু ২০১৮ সালের ৮ মে শহরবাসীর জন্য বয়ে আনল এক নিদারুণ ভাগ্য বিপর্যয়ের খবর। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেদিন ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে আমেরিকার বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিতে চলেছিলেন।
এই ঘোষণা ছিল ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ইঙ্গিত। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ধসে যায় দেশটির অর্থনীতি। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সংস্কারপন্থী ইরানিদের স্বপ্ন।
'ট্রাম্প যা করতে যাচ্ছেন, তা হলো এই শাসনের আয়ু আরও ৩০ বছর বাড়িয়ে দেওয়া,' আমেরিকান প্রেসিডেন্টের ভাষণের কয়েক ঘণ্টা আগে সিএনএনকে এ কথা বলেছিলেন এক প্রবীণ ইরানি-আমেরিকান। স্বৈরাচারী, কট্টর পশ্চিমাপন্থী শাহকে উৎখাত করা ইসলামি বিপ্লবের ৪০ বছর পূর্তি ছিল কয়েক মাস পরেই। অন্যদিকে পারমাণবিক চুক্তিটিকে ইরানে সংস্কার আনার প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছিল।
২০১৭ সালের জুনে ইরানিরা দলে দলে ভোট দিয়ে হাসান রুহানিকে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আনেন। এই ভোটের জোয়ারকে দেখাচ্ছিল তার সম্পাদিত ঐতিহাসিক চুক্তির পুরস্কার স্বরূপ। পশ্চিমের কাছে রক্ষণশীল এই দেশের এমন উদারবাদী মনোভাব বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল।
কিন্তু এরপরই দৃশ্যপটে এলেন ট্রাম্প। ইরানিরা জানতেন, তার পরিকল্পনা বিপর্যয় ডেকে আনবে। তথাকথিত 'সর্বোচ্চ চাপ' ইরানের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পতন ঘটাতে পারবে না। উল্টো আরও শক্তিশালী হবে প্রতিষ্ঠানটি।
ইরান দর কষাকষি চালিয়ে গেছে, কিন্তু আমেরিকা তাতে সাড়া দেয়নি। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানে খাদ্য ও ওষুধের ঘাটতি দেখা দেয় এবং দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে অস্থির করে তোলে। দেখা গেল, চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ইউরোপীয় দেশগুলোর এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় সারিয়ে তোলার ক্ষমতা নেই।
এরপর অনেক ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালে ট্রাম্প ইরানের সবচেয়ে সম্মানিত জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দেন। যা রক্ষণশীলদের আরও খেপিয়ে তোলে।
এই অঞ্চলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি জনসমাগম হওয়া শেষকৃত্যগুলোর একটি হলো তার শেষকৃত্য। এ বছরই নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা ছাড়া হন ট্রাম্প। তার উত্তরসূরি জো বাইডেন দায়িত্ব নিয়েই এই চুক্তিতে আবার যোগ দিয়েছেন। সংস্কারবাদী ইরানিরা ভেবেছিলেন, এবার হয়তো ২০১৮-র মে মাসের পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়া যাবে আবার।
কিন্তু ইরানের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সেই অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা সরাসরি নাকচ করে দেয়। এই সপ্তাহের নির্বাচনেও, ইব্রাহিম রাইসিকে জেতানোর মাধ্যমে, তাদের সেই 'না'-এর প্রতিধ্বনিই হয়েছে সজোরে। গত কয়েক দশকে ইরানের ক্ষমতায় আসা সবচেয়ে কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট হলেন বিচারপতি রাইসি।
ইসলামিক রিপাবলিকের মানদণ্ডেও এবারের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ফলাফল নির্লজ্জতায় একেবারেই ব্যতিক্রম ছিল। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলি খামেনি এবার প্রচণ্ড কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। ইরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর অতি রক্ষণশীল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ আরও সর্বব্যাপী হবে।
তবে রাইসি চার নাকি আট বছর ক্ষমতায় থাকবেন, তারচেয়েও লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এবারের নির্বাচন আগের ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়েছে।
৮১ বছর বয়সি অসুস্থ খামেনির ঘনিষ্ঠ সহযোগী রাইসিকে আচমকাই আয়াতুল্লাহ বলে ডাকা হচ্ছে, যা শিয়াদের সর্বোচ্চ পদ। বর্তমানে খামেনি এই পদবির অধিকারী। এর আগে শিয়াদের এই সর্বোচ্চ পদমর্যাদার অধিকারী ছিলেন তারই পূর্বসূরি এবং ইসলামিক রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠাতা রুহুল্লাহ খোমেনি।
নির্বাচনের সময় তেহরান খামেনির পাশাপাশি রাইসির ছবিতে ছেয়ে গিয়েছিল। লোকজন ফিসফাস করেছে, সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হওয়ার আগে খামেনিও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হওয়ার যাত্রায় রাইসিও খামেনির অনুসরণ করা পথেই আছেন।
এতে অনেক ইরানিই নাখোশ হয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সাংবিধানিক সংস্কারের ওপর খামেনি নিজের উত্তরাধিকার মজবুত করেছেন। রক্ষণশীল গার্ডিয়ান কাউন্সিল, যা প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের বাছাই করে, রাইসির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রার্থিতা বাতিল করে দিয়েছে। ফলে দেশটির ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই প্রথম ৫০ শতাংশেরও কম ভোটার উপস্থিতি দেখা গেছে।
ইরানের সবচেয়ে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ দিনগুলোতে রাইসির ভূমিকা সংস্কারপন্থী ইরানিদের আরও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। রাইসি দুই বছর ইরানের রক্ষণশীল বিচার বিভাগীয় শাখার নেতৃত্ব দিয়েছেন। অতি সামান্য ভিন্নমত পোষণের কারণেও—যেমন, হিজাব পরার বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধেপ্রতিবাদ—দীর্ঘ মেয়াদে জেল দেয় ইরানের বিচার বিভাগ। অভিযোগ আছে, ১৯৮৮ সালে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে গোপনে খুন ও গুম করেছিল যে কমিশন, তার সদস্য ছিলেন রাইসি। আইনজীবী হিসেবে বাকি পেশাজীবনে তিনি ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো অনেক ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন।
ইরানের বেশিরভাগ ভোটারই রাইসিকে ভোট দেননি। এই জন-অসন্তোষ নিয়েও নির্বাচন আয়োজন করেছেন ধর্মীয় নেতারা। যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপের জন্য ইরানি জনগণকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। মুমূর্ষু অর্থনীতির চাপে জেরবার ইরানিরা বারবার বড় আকারের বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে গেছে দেশটির। ধর্মীয় নেতারা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চান। মধ্যপন্থী রাজনীতিবিদরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নিষেধাজ্ঞার কারণে সরকার অনেকক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের মতো চৌকশ মধ্যস্থতাকারী ও কূটনীতিকরা দুর্বল হয়ে পড়েছেন।অন্যদিকে ট্রাম্পের এই নিষেধাজ্ঞার লাভের গুড় খেয়েছেন কট্টরপন্থীরা। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর বুদ্ধিতে দেওয়া ইরানের ওপর সবচেয়ে আক্রমণাত্মক নিষেধাজ্ঞার চাপেও টিকে গেছেন কট্টরপন্থীরা।
ইরানের এবারের নির্বাচনের বার্তাটি গোটা অঞ্চলে পৌঁছে গেছে: সবচেয়ে অস্থিতিশীল এই সময়ে কেবল একনায়করাই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেন। বর্তমান সময়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সবচেয়ে বড় দুই বিজ্ঞাপন হলেন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ও সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ। এই দুজনই রাইসিকে বিজয়ের জন্য ত্বরিত অভিনন্দন জানিয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের শাসকগোষ্ঠীর সমর্থকরা যুক্তি দেখান, এই অঞ্চলের শাসক এবং জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব অন্তত তাদের ওপর পশ্চিমা হস্তক্ষেপের কম ঝুঁকিপূর্ণ।
ট্রাম্পের সর্বোচ্চ চাপের কৌশলটি অবশ্য নতুন নয়। ১৯৫৩ সালে সিআইএ মদদে এক অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সেকুলার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে উৎখাত করা হয়। সেই থেকে ইরানে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে শুরু করে। আজ মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র আগের চেয়েও অলীক। সংস্কার ও গণতন্ত্রের দাবিতে বারবার বিক্ষোভে কেঁপে উঠেছে এই অঞ্চল। কিন্তু বিশৃঙ্খল এসব বিক্ষোভ সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক অভিজাতদের সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রতিবার। তাই জনৈক ইরানির দাবি মতো, এই অঞ্চলে সত্যিকার পরিবর্তন আসতে হয়তো আরও ত্রিশ বছর লেগে যাবে।
-
সূত্র: সিএনএন