ইসরায়েলি পেগাসাস: আপনার ফোন কি ‘২৪ ঘণ্টার নজরদারি ডিভাইস’?
২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে বাহরাইনের নয় নাগরিকের আইফোন হ্যাক করা হয়। সাইবার নজরদারি প্রতিষ্ঠান এনএসওর নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। হ্যাকিংয়ের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে লন্ডনে আশ্রয় নেওয়া দুই ব্যক্তি ছাড়াও বাহরাইনের মানবাধিকার রক্ষা কেন্দ্রের তিন সদস্য ছিলেন।
সম্প্রতি টরন্টো ইউনিভার্সিটির সিটিজেন ল্যাব থেকে প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে হ্যাকিংয়ের এই তথ্য প্রকাশিত হয়।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুসারে, পেগাসাস "এ পর্যন্ত নির্মিত স্পাইওয়্যারগুলোর মধ্যে সবথেকে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন" যা একটি মোবাইল ফোনকে "২৪ ঘণ্টার নজরদারি ডিভাইসে" পরিণত করতে পারে। পেগাসাসের মাধ্যমে টেক্সট বার্তা, পাসওয়ার্ড, ছবি, ইন্টারনেটে সার্চকৃত তথ্য এবং ফোনের অন্যান্য তথ্যাদি সংগ্রহ করা সম্ভব। একইসঙ্গে ফোনের ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোনের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে পেগাসাস।
সবথেকে মজার বিষয় হলো, এর সবটাই 'জিরো-ক্লিক' প্রযুক্তি ব্যবহার করে করা সম্ভব। যার অর্থ, টার্গেটেড কোনো ফোনকে আক্রান্ত করতে চাইলে ব্যবহারকারীর কোনো হ্যাকিং লিংক বা অন্য কিছুতে ক্লিক করারও প্রয়োজন পড়ে না।
বাহরাইনের সমাজকর্মীরা কেবল রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারী আচরণের ভুক্তভোগী নন। একইসঙ্গে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের গোপনীয়তা রক্ষার স্বাধীনতা।
তবে এটা কেবল পেগাসাসের ডিসটোপিয়ান কল্পকাহিনীর নতুন এক পর্ব মাত্র।
চলতি বছরের জুলাইয়ে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে বিশ্বের ১৭টি গণমাধ্যম ও প্যারিসভিত্তিক এনজিও ফরবিডেন স্টোরিজ মিলিতভাবে 'প্যাগাসাস প্রজেক্টের' মাধ্যমে বিশ্বের ৫০ হাজারের অধিক স্মার্টফোন নাম্বারের তালিকা প্রকাশ করে। অধিকাংশ নাম্বারই ছিল এনএসওর গ্রাহক দেশগুলোর। নাম্বারগুলো পেগাসাসের টার্গেটের শিকার হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
পেগাসাস প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, তালিকায় থাকা নাম্বারগুলোর মধ্যে ৩৭টি নাম্বারে পেগাসাসের আক্রমণের চেষ্টা বা হ্যাকিংয়ের নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে সাংবাদিক, সমাজকর্মী ছাড়াও ছিলেন ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে হত্যাকাণ্ডের শিকার কলাম লেখক 'জামাল খাসোগির ঘনিষ্ঠ দুই নারী'।
হত্যাকাণ্ডের ঠিক একদিন আগে খাসোগির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী ওমর আবদুল আজিজের ফোন প্যাগাসাসের মাধ্যমে হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে বলে সতর্ক করে সিটিজেন ল্যাব।
তালিকাভুক্ত নাম্বারগুলোর ৫০ হাজারের মধ্যে ১৫ হাজারই ছিল মেক্সিকোর। ২০১১ সাল থেকে এনএসওর প্রথম গ্রাহক কম পরীক্ষামূলক গিনিপিগের ভূমিকায় রয়েছে মেক্সিকো। মেক্সিকান ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার সিসিলিও পিনেদার ফোন নাম্বার এই তালিকায় দুবার আসে। গুলিবিদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সিসিলিও। ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে লিখে, "টার্গেটের বর্তমান অবস্থান শনাক্ত করতে পারার যে ক্ষমতা পেগাসাসের রয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডে সেই ভূমিকা অস্পষ্ট।"
রয়টার্সের মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি মেক্সিকান সরকার পেগাসাসের সঙ্গে ১৬০ মিলিয়ন ডলারের অধিক পরিমাণ অর্থের চুক্তি স্বাক্ষর করে। ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট এনরিখ পেনা নিয়েতো ক্ষমতায় থাকাকালে অধিকাংশ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৪ সালে পুলিশের মাধ্যমে অপহৃত ৪৩ জন শিক্ষার্থীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার অনুসন্ধানে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের লক্ষ্য করেও এই স্পাইওয়্যার ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে।
নিয়েতোর পর ক্ষমতায় আসা বামপন্থী মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদর ও তার স্ত্রী ও সন্তানদেরও টার্গেট করা হয়।
বাহরাইনে হ্যাকিংয়ের শিকার নয়টি নাম্বারের পাঁচটি পেগাসাস প্রজেক্টের তালিকায় ছিল বলে নিশ্চিত করেছে সিটিজেন ল্যাব। ইসরায়েলের সঙ্গে বাহরাইনের সম্পর্ক মাত্র গতবছর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাভাবিক হলেও ধারণা করা হয় বাহরাইনের সরকার ২০১৭ সাল থেকেই পেগাসাস ব্যবহার করে আসছে।
২০১৬ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত স্বনামধন্য মানবাধিকার কর্মী আহমেদ মনসুরের ফোন হ্যাক করতে এনএসও স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে। এক বছর পর মনসুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এখনও কারাবন্দী রয়েছেন।
২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলে বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গার থেকে নজরদারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। সাবেক ইসরায়েলি সেনাসদস্যদের উদ্যোগে গঠিত এনএসও ও পেগাসাস ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর উন্নত সাইবার স্পাই প্রযুক্তি বেসরকারি খাতে ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত প্রসার লাভ করে।
এনএসওর ওয়েবসাইটে 'মানবাধিকার নীতিমালা' অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির প্রযুক্তি কেবল 'জঙ্গিবাদের মতো গুরুতর অপরাধের তদন্ত ও তা প্রতিরোধ করতে ব্যবহৃত হয়।" মানবাধিকার লঙ্ঘনে এই প্রযুক্তি ব্যবহার না করার নিশ্চয়তাও দেওয়া হয় এই নীতিমালায়।
এসএসও প্রতিনিধিরা বরাবর তাদের সফটওয়্যারের ব্যবহার সন্ত্রাসবিরোধী ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের দাবি করে আসছে। পেগাসাস ব্যবহারের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তারা অস্বীকার করলেও খাসোগি হত্যাকাণ্ডের মতো আরও অনেক অপরাধের সঙ্গেই তাদের সম্পৃক্ততা নিছক কাকতালীয় হতে পারে না।
- সূত্র: আল-জাজিরা