ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার: হ্যাক করা হয়েছে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও অধিকারকর্মীদের স্মার্টফোন
ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের তৈরি স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, ব্যবসায়ীদের ওপর নজরদারি করেছে বিভিন্ন দেশের সরকার। এছাড়াও নিহত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এমন দুই নারীসহ সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের ফোনেও আড়ি পাতা হয়েছে।
আড়ি পাতার শিকার হওয়া মোট ৩৭টি স্মার্টফোনের তথ্য ফাঁস হয়েছে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-সহ ১৬টি সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
নজরদারির আওতায় থাকা ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বরের একটি তালিকা ফাঁস হয়েছে। এই ফোন নম্বরগুলো যেসব দেশের, সেসব দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের ওপর নজরদারি করার জন্য পরিচিত। ইসরায়েলি সংস্থা এনএসও গ্রুপের গ্রাহক হিসেবেও পরিচিত এসব দেশ। এনএসও হচ্ছে বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান বেসরকারি স্পাইওয়্যার শিল্পের নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও সংবাদ সংগঠন ফরবিডেন স্টোরিজের এসব ফোন নম্বর ও স্মার্টফোনে প্রবেশাধিকার ছিল।অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাবে স্মার্টফোনগুলোর ফরেনসিক বিশ্লেষণ হয়।
ফাঁস হওয়া ৫০ হাজার নম্বরের মধ্যে সাংবাদিকরা ১ হাজারের বেশি নম্বরের মালিককে খুঁজে বের করতে পেরেছেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আরব রাজপরিবারের সদস্য আছেন। আছেন কমপক্ষে ৬৫ জন ব্যবসায়িক নির্বাহী, ১৮৯ জন সাংবাদিক এবং ৬০০-র বেশি রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা। এছাড়াও আছেন মন্ত্রী, কূটনীতিক এবং সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা। কয়েকটি দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীও রয়েছেন এ তালিকায়।
সিএনএন, এপি, ভয়েস অব আমেরিকা, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ব্লুমবার্গ নিউজ, লা মন্ড, ফাইন্যানসিয়াল টাইমস এবং আল জাজিরার সাংবাদিকরা ছিলেন নজরদারির আওতায়।
এনএসও'র দাবি, তাদের তৈরি পেগাসাস নামক স্পাইওয়্যারটি কেবল সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের ফোনে আড়ি পাততেই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ বলছে, পেগাসাস ব্যবহার করে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের ওপর নজরদারির মাধ্যমে ইসরায়েলি কোম্পানিটি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।
এনএসও অবশ্য প্রকাশিত তথ্য-প্রমাণকে অতিরঞ্জিত ও ভিত্তিহীন দাবি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আরও দাবি করেছে, গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা স্পাইওয়্যার তারা চালায় না এবং গ্রাহকদের গোয়েন্দা কার্যক্রম সম্পর্কে তাদের 'কিছুই জানা নেই'।
এনএসও-র প্রধান শালেভ হুলিয়ো ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, যেসব গ্রাহক পেগাসাসের অপব্যবহার করেছে, এনএসও তাদের সিস্টেম বন্ধ করে দিয়েছে। হুলিয়ো আরও দাবি করেন, গত এক বছরে মানবাধিকার লঙ্ঘন করার অভিযোগে এনএসও দুটি চুক্তি বাতিল করেছে। যদিও অভিযুক্ত দেশগুলোর নাম জানাতে তিনি রাজি হননি।
এনএসও জানিয়েছে, ৪০টি দেশের ৬০টি গোয়েন্দা, সেনা ও আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী তাদের গ্রাহক। যদিও প্রতিষ্ঠানটি কোনো গ্রাহকের নাম ফাঁস করেনি।
ফাঁস হওয়া ফোন নম্বরগুলো বিশ্লেষণ করে সিটিজেন ল্যাবের গবেষণায় এনএসও'র অন্তত ৪৫টি ক্রেতা দেশের নাম জানা গেছে। দেশগুলো হলো: ভারত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, আলজেরিয়া, আজারবাইজান, বাহরাইন, হাঙ্গেরি, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, কেনিয়া, পোল্যান্ড, মেক্সিকো, মরক্কো, রুয়ান্ডা, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, কাতার, ইরাক, ইসরায়েল।
এনএসও'র বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও ফরবিডেন স্টোরিজের বেশ কয়েকজন অনুসন্ধানকারী জানতে পারেন যে, তাদের কিংবা তাদের পরিবারের ওপর পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে।
যে ৫০ হাজার ফোন নম্বর ফাঁস হয়েছে, তার একটি বড় অংশই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, যেমন কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরব ও ইয়েমেনের।
ভারতের শতাধিক সাংবাদিক, অধিকার কর্মী, বিরোধী রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, ও ব্যবসায়ীর ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আড়ি পাতা হয়েছে মেক্সিকোর নাগরিকদের ওপর।
পেগাসাসের মতো স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে দমনমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনা ক্রমশই বাড়ছে।
অবশ্য এনএসও'র দাবি, তাদের প্রযুক্তি অনেক বোমা হামলা, মাদক চোরাচালান, নারী ও শিশু চোরাচালান আটকাতে সাহায্য করেছে। তাদের মতে এনএসও মানুষের 'জীবনরক্ষার ব্রত' নিয়ে কাজ করছে।
- সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট