কাতার ফিরলেও অমীমাংসিত রবে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর বিরোধ
পারস্য উপসাগর তীরবর্তী আরব দেশগুলোর জোট জিসিসি (গালফ কো-অপারেশেন কাউন্সিল)। ট্রাম্প প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার প্র্রথম দিকেই এর সদস্য কাতারের উপর অবরোধ আরোপ করে জিসিসি'র তিন সদস্য সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহারাইন। পরে এতে মিশরও যোগ দেয়।
অবরোধটিতে উপসাগরীয় আরবেরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই অচলাবস্থা অবশ্য দ্রুত সমাধানের দিকে এগিয়ে চলেছে। আর আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, স্বল্পমেয়াদে সকল পক্ষই এ সমাধানে বিজয়ী হবে। তবে, যেহেতু বিরোধের প্রকৃত কারণ সুরাহা হয়নি তাই সমঝোতাটি দীর্ঘমেয়াদে কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়।
গত সোমবার ছয় সদস্যের জিসিসি দেশগুলোর ৪১তম বৈঠকের আগে কাতার এয়ারওয়েজের জন্য নিজ আকাশপথ উন্মুক্ত করার ঘোষণা দেয় সৌদি আরব। সঙ্গে স্থলসীমানাও খুলে দেওয়া কথা জানিয়েছে দেশটি। অবরোধ আরোপকারী জিসিসিভুক্ত অপর দুই দেশ; সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহারাইন খুব শিগগির তাদের পক্ষ থেকে ভ্রমণ এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে, বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। আর চতুর্থ দেশ মিশর তাদের পদাঙ্কই অনুসরণ করবে।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই এ সমাধানকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবে। কারণ; ২০১৭ সালের ৫ জুন অবরোধ আরোপের পর থেকেই উপসাগরীয় মিত্রদের মধ্যে চলা আসা এ দ্বন্দ্ব বাহ্যত নিরসনের চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন শেষ সময়ে এসে কাতার অবরোধ বাতিলে করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। আর তাই যেকোনো ধরনের আপোষ হলে মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে আরেকটি বড় সাফল্য দাবি করতে পারবেন ট্রাম্প। শুধু তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের মতো সংবেদনশীল অঞ্চলে বিরোধহীন মিত্রজোট পেয়ে নিঃসন্দেহে খুশিই হবেন নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
কাতার দীর্ঘদিন ধরেই একটি সমাধানের প্রত্যাশা করছিল। কারণ দোহা অবরোধের স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদি প্রভাব এড়াতে জোট বহির্ভূত অনারব দেশ যেমন; তুরস্ক ও ইরানের সহযোগিতা নেয়। তবে বাস্তবতা হলো; দোহা জানতো কাতারের জন্য শ্রেষ্ঠ উপায় তার বড় প্রতিবেশী আরব দেশসমূহের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপন করা।
কিন্তু, আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা এড়াতে কাতার কী ছাড় দেবে- তা শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিল না।
একটা বিষয় স্পষ্ট, দোহা আপাতত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে জাতিসংঘে দায়ের নানা অভিযোগ ও আন্তর্জাতিক আদালতে করা মামলা প্রত্যাহার করবে। কিন্তু, তারপরও রাজনৈতিক এবং আদর্শিক বিরোধ থাকবেই। অবরোধ আরোপকারী দেশগুলোর প্রত্যাশা থাকবে; কাতার যেন এসব পার্থক্য দূর করতে উদ্যোগী হয়।
জিসিসি ভুক্ত দেশে কাতারের রাজনৈতিক আদর্শের সবচেয়ে বড় বিরোধী সংযুক্ত আরব আমিরাত। মুসলিম ব্রাদারহুডসহ নানা ইসলামী রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে আরব রাজনীতির মূলধারায় জোরালো সমর্থন দেয় কাতার। ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় তা আমিরাতের শাসকদের জন্য অসহনীয়। রিয়াদও এসব ব্যাপারে কিছুটা সংবেদনশীল। তবে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের বিরোধী কিছু রাজনৈতিককে দেওয়া কাতারি সমর্থন নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন সৌদি প্রশাসন। দেশটির দাবি, কাতার তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিরোধী পক্ষকে মদত দেয়।
অবরোধ আরোপ করার সময়েই মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করাসহ কাতারের প্রভাবশালী আল জাজিরা টিভি নেটওয়ার্ক বন্ধের শর্ত দিয়েছিল চারটি দেশ। চ্যানেলটি নিঃসন্দেহে বন্ধ হবে না। তবে পর্যবেক্ষকেরা এর সম্পাদকীয় নীতিতে লক্ষ্যণীয় পালাবদল আসছে কিনা- সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। কাতারের প্রতিবেশীদের দাবি, এ প্রচারণা নীতি তাদের স্বার্থের জন্য বড় হুমকি।
এসব বিরোধের শেকড় অনেক গভীরে, আর এসব নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে চোখ রাঙ্গানি বা দর কষাকষিও এই প্রথম নয়য়। অবরোধপূর্ব সময়, ২০১৩-১৪ সালেও এক স্বল্পমেয়াদি কিন্তু তীব্র অচলাবস্থা দেখা গিয়েছিল। ওই সময় উভয়পক্ষে দেওয়া কিছু আশ্বাসের ভিত্তিতে বিরোধ মেটে। কিন্তু, কাতার দৃঢ় অঙ্গীকার করেনি, তাই মূল ইস্যুগুলোর সমাধান হয়নি। কাজে করে দেখানোর চাইতে তাদের অঙ্গীকার শুধু কাগজে-কলমেই রয়ে যায়। এরই ফলশ্রুতি ২০১৭ সালের অবরোধ। দোহা তার পক্ষ থেকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি- সেটা জানান দিতেই যেন ভ্রমণ ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
এবার কী কাতার তার অঙ্গীকার রক্ষা করবে? আল জাজিরা বন্ধ হওয়াটা হতে পারে একটি সম্ভাবনা। কিন্তু, সৌদি ও আমিরাতের ক্ষোভের কারণ; তুরস্কের সঙ্গে কাতারের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার সম্পর্ক তাতে বাধাগ্রস্ত হবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
তাই আমিরাত সৌদিকে অনুসরণ করে বয়কট প্রত্যাহার করলেও, তার প্রধান উদ্বেগের কারণ সুরাহা হবে না। সৌদি আরব অবশ্য ইরানের হুমকি নিয়ে বেশি চিন্তিত। তাই যেকোনো উপায়ে দোহাকে তেহরানের আলিঙ্গন থেকে দূরে রাখাটাই আপাতত রিয়াদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে।
সৌদি শাসকদের জন্য কাতারকে বয়কট করাটা চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু, তারপরও তারা এখনই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, এমন প্রত্যাশা করে না। আর ধর্মপ্রাণ ইহুদি ট্রাম্প জামাতা জ্যারেড কুশনারও চান একটি ইরান বিরোধী জোট। এর ফলে, বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে ইরানের সঙ্গে সমঝোতা করাটা বেশ কঠিন হবে। তবে মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে তেহরানকে প্রতিরোধে সচেষ্ট হতে পারবেন তিনি। সেই রূপরেখা কাতারের অবরোধ প্রত্যাহারের মাধ্যমে করতে শেষ সময়ে এসে সচেষ্ট হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই পদক্ষেপ সফল হলে তাতে বরাবররের মতোই সবচেয়ে বেশি লাভ হবে ইসরায়েলের।
জিসিসি'র নেতৃত্ব সৌদির হাতেই । আর দেশটি চায় সব সদস্য দেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রপন্থী একটি জোট গঠন করতে। তাই অবরোধ তুলে নিয়ে কাতারকে ইরানের মিত্র থেকে শত্রুতে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে, দোহার অনমনীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ বজায় থাকলে সৌদি আরব কতদিন সমঝোতার পথে থাকবে, সেটা ঘিরেই মূল অনিশ্চয়তা।
মূল থেকে সার-সংক্ষেপিত অনুবাদ: নূর মাজিদ