ক্ষমতা ছাড়তে রাউলের প্রস্তুতি, কিউবায় অবসানের মুখে এক গৌরবোজ্জ্বল যুগ
বছর তিনেক আগে যখন রাউল কাস্ত্রো ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২০২১ সালে কিউবার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নেতার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন, তখন নিশ্চয়ই তিনি ছোট্ট এই দ্বীপ রাষ্ট্রকে অদূর ভবিষ্যতে অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী একটি স্থানে কল্পনা করেছেন এবং নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের হাতে দেখতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু সবকিছু তার পরিকল্পনামতো ঘটেনি। পর্যটননির্ভর কিউবা মহামারির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে এবং সরকারি হিসাবমতে, ২০২০ সালে দেশটির অর্থনীতি কমেছে কমপক্ষে ১১ শতাংশ। কিউবানদের প্রতিদিনই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে প্রায় ফুরিয়ে আসা খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য।
সংক্রমণ ঠেকাতে কিউবা সরকার সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে কোভিড-১৯ আক্রান্তের হার বেড়েই চলেছে। কিউবা সত্যিকার অর্থেই উচ্চাভিলাষী হয়ে নিজেরাই ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করতে যাবে কি না, তা জানতে সময় লাগবে আরও কয়েক মাস।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে রাউল দীর্ঘকালের কিউবা-আমেরিকা দ্বন্দ্ব মেটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময় সেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, যা কিউবাকে অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করে। এদিকে, কিউবার নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এলেও, এখনো পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে অনিচ্ছুকই দেখা গিয়েছে।
অর্থবহ সম্পর্ক তৈরিতে উৎসাহিত করতে নিয়োজিত জিওপি'র একজন সদস্য ও বেশ কয়েকবার কিউবা ভ্রমণ করা সাবেক সিনেটর জেফ ফ্লেক (আর-এজেড) বলেন, 'রিপাবলিক হোক বা ডেমোক্রেট, আমাদের উচিত এখনই যুক্ত হওয়া। এটা কিউবার মানুষের উপকার করবে এবং কিউবা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে- যা আমরা তাদের দূরে সরিয়ে দিয়েও করতে পারিনি।'
কিউবাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা প্রবীণ প্রজন্মের কাছে এর চেয়ে বিপজ্জনক সময় হয়তো-বা আর আসবে না। অনিশ্চয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি এ সপ্তাহে দেশটির একমাত্র রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম কংগ্রেসে কিউবানরা একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করবে।
শুক্রবার শুরু হতে যাওয়া এই কংগ্রেসে বে অব পিগস আক্রমণের দিন সিআইএ প্রশিক্ষিত নির্বাসনের বিরুদ্ধে কিউবার জয়ের ৬০তম বার্ষিকী পালন করা হবে। সেইসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে রাউল কাস্ত্রোও ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবেন।
বিপ্লবের শুরু দিনগুলো থেকেই কিউবার রাষ্ট্রপ্রাধানই সবসময় দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। কিন্তু তারা নির্ধারণ করতে পারেননি- সরকার কোথায় গিয়ে শেষ হবে এবং দল কোথায় শুরু হবে।
তবে ২০১৮ সালে রাউল কাস্ত্রো প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর উত্তরাধিকারী মিগুয়েল ডিয়াজ-ক্যানেলকে প্রতিদিনকার সরকারি কাজগুলো দেখাশোনার জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। যদিও রাউল তখনো দলের প্রধান হিসেবে ছিলেন এবং বলা হয়েছিল, ২০২১ সালে ডিয়াজ-ক্যানেলই সে অবস্থান অধিকার করবেন।
২০১৮ সালে রাউল বলেন, 'যদি আমার স্বাস্থ্য সহায় থাকে, তাহলে এই বিপ্লব রক্ষায় একজন সহযোদ্ধা হিসেবেই কাজ করে যাব।'
রাউলের বিদায়ের মাধ্যমে এক খ্যাতনামা বংশানুক্রমিক শাসন যুগের অবসান ঘটবে এই দ্বীপে। ২০১৫ সালে মৃত্যুবরণ করা তার বড়ভাই ফিদেল কাস্ত্রোর কোনো সন্তানও সরকারি কোনো পদে নেই।
রাউল কাস্ত্রোর ছেলে আলেসান্দ্রো কিউবার ইন্টেরিয়র মিনিস্ট্রির একজন কর্নেল এবং তার কন্যা মারিয়েলা এলজিবিটিকিউ গোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার কাজে নিয়োজিত একটি সরকারি সংস্থা চালান। রাউলের মেয়েজামাই জেন লুইস আলবার্তো রদ্রিগেজ লোপেজ-ক্যালেয়াস একটি বড় মিলিটারি কোম্পানির প্রধান, যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত হোটেল, প্রমোদতরী বন্দর ও অবকাঠামোগত প্রজেক্টগুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তার। তবে তিনিও একজন সাধারণ নাগরিকের মতোই জীবনযাপন করেন।
তারা যদি প্রশ্নাতীতভাবে ক্ষমতা ধরেও রাখেন, কংগ্রেস শেষ হয়ে যাবার পরপরই, ৬২ বছরের মধ্যে এই প্রথম কাস্ত্রো পরিবারের কেউই আর নেতৃত্বের বড় কোনো পদে থাকবেন না।
স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে কিউবাই একমাত্র দেশ, যেখানে নিজেদের তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি বললেই চলে। যদিও সরকারি কর্মকর্তারাও জানেন, দ্বীপটিতে অবশ্যই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে উঠেছে। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিউবার অর্থনীতির আধুনিকায়নের দায়িত্বও এবার হবু প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নেতা হতে যাওয়া মিগুয়েল ডিয়াজ-ক্যানেলের কাঁধে পড়বে।
ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিয়ানিয়ারিংয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিগুয়েল ইতিপূর্বে স্থানীয় দুটি রাজ্যের শাসনের দায়িত্বে ছিলেন। এরপর তিনি প্রথমে উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ও পরে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্ট হন।
ডিয়াজ-ক্যানেলই ১৯৫৯ সালের বিপ্লবের পরে জন্ম নেওয়া একমাত্র কিউবান, যিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। দলের নেতৃত্ব হাতে পাওয়াই এই লম্বা, ধূসর-চুলের প্রযুক্তিবিদকে কাস্ত্রোর উত্তরসূরি হিসেবে এগিয়ে নেবে। কিন্তু তিনি পূর্বসূরিদের চেয়ে কোন কোন দিক থেকে আলাদা, তা এখনো অস্পষ্টই থেকে যাচ্ছে।
২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে কিউবার ভবিষ্যত সম্পর্কে ডিয়াজ-ক্যানেল বলেছিলেন, 'আমি ধারাবাহিকতায় বিশ্বাস করি এবং মনে করি এটা সবসময়ই বজায় থাকবে।'
নিয়মিত টুইটারে পোস্ট করার মাধ্যমে ডিয়াজ-ক্যানেল কিউবানদের সম্পর্কে একটি সক্রিয় চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি ২০১৮ সালে হাভানায় এক বিমান দুর্ঘটনায় ১১২ জন মারা যায় যে স্থানে, তা পরিদর্শন করেছেন। এছাড়াও তিনি ফিদেল কাস্ত্রোর মতোই দেশজুড়ে ক্যাবিনেট মিটিংগুলো পরিচালনা করেন।
দৃষ্টিভঙ্গি সামান্য বদলালেও দশকের পর দশক ধরে স্থবির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, ডিয়াজ-ক্যানেল কিউবার অদমনীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থারই পক্ষপাতী এবং তিনি মনে করেন, কিউবার জন্যে এটিই সবচেয়ে ভালো পথ। বিরোধী কোনো দল তৈরি করা কিউবানদের দায়িত্ব বলে তিনি জানান। তিনি কিউবানদের সেক্ষেত্রে 'মাল নাসিদোস' বা ভুল দেশে জন্ম বলে অভিহিত করেন।
তবে এই ধারা বজায় রাখার কথা সরকারিভাবে জানালেও কিউবায় পরিবর্তন আসছে। কিউবার বর্ধনশীল অনেক বেসরকারি খাতই এখন খোলাখুলিভাবে এই স্থবির উন্নয়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। সরকারি সেন্সরশিপ বিরক্ত করে তুলেছে শিল্পীদের এবং প্রাণী অধিকার রক্ষার আইনের জন্য কাজ করা কর্মীবৃন্দ ইন্টারনেটের ব্যবহারও বাড়িয়ে দিয়েছে এবং নিজেরা ছোটখাট আন্দোলনে সংগঠিত হচ্ছে, যা কয়েক বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল।
কিউবা সরকার নানারকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে থাকায়, কেউ কেউ রাউলের বিদায় নিয়ে ভীত। কিন্তু সাবেক সিনেটর জেফ ফ্লেক সিএনএনকে জানান, রাউল তার বিদায়ের বিরুদ্ধে আসা শেষ মুহূর্তের কোনো আবেদনও রাখবেন না।
'তাকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে হেঁটে বেড়ানোর দিকেই এখন বেশি আগ্রহী দেখা যায়, যেমনটা ফিদেল করতেন। তিনি সবসময় নিজের নাতিপুতি ও পরিবারের কথা বলেন। কিন্তু সত্যিই এগিয়ে যেতে হলে কিউবাকে অবশ্যই কাস্ত্রোদের নীতির বাইরে এসে কাজ করতে হবে', বলেন ফ্লেক।
-
সূত্র: সিএনএন