চীন কি এখনও ‘জিরো কোভিড’ নীতি নিয়ে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে?
মহামারি ঠেকাতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বেশি কিছু দেশ 'জিরো কোভিড' কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। তবে গত কয়েক মাসে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো এ অঞ্চলের কয়েকটি দেশ এ নীতি থেকে সরে এসে 'ভাইরাসের সঙ্গে সহাবস্থান'-নীতি অবলম্বনের ইঙ্গিত দিয়েছে।
দেশগুলোর এ সিদ্ধান্তের পর অনেকের মনেই আগ্রহ জন্মেছে—চীন কি এবার নিজের নীতি থেকে সরে আসার কথা ভাববে? প্রায় ৮০ শতাংশ জনসংখ্যাকে পূর্ণ ডোজ টিকা দিয়েছে দেশটি। চীন এখন তাদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত কবে খুলে দেয়, সেটা নিয়ে জল্পনা চলছে আন্তর্জাতিক মহলে।
এক সাক্ষাৎকারে চাইনিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর প্রধান গাও ফু আশা প্রকাশ করেন যে, আগামী বছরের শুরুতে সীমান্ত খুলে দেওয়ার কথা ভাবতে পারে চীন। ততদিনে দেশটির ৮৫ শতাংশ মানুষ পূর্ণ ডোজ টিকার আওতায় আসবে।
তবে চীনের আরেক প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ ঝং ন্যানশান মত দেন যে, পৃথিবীর বাকি অংশে মৃত্যু ও সংক্রমণ হার না কমা এবং টিকাদানের গতি না বাড়া পর্যন্ত চীনের সীমান্ত খোলা উচিত হবে না।
কিন্তু অনেক দেশই ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে লড়ছে। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন যে, এই ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা অত্যন্ত কঠিন। ভাইরাসটি আরো বহু দিন সক্রিয় থাকবে।
এমন পরিস্থিতিতে চীন তার 'জিরো কোভিড' নীতি বদলাবে কি না, তা নিয়ে জোর প্রশ্ন উঠেছে। তবে চীন সরকার এখনই এই নীতি থেকে সরে আসতে মোটেও ইচ্ছুক নয়। তবে চীন সরকারের উচিত জিরো কোভিড নীতি আর একটু শিথিল করা এবং আরো বেশি সহমর্মিতা দেখানো।
গত বছর প্রথম বড় অর্থনীতি হিসেবে করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনে চীন। কাজটি তারা করে কঠোর লকডাউন, বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন, ব্যাপক টেস্ট ও কঠোরভাবে সীমান্ত বন্ধ রেখে। এরপর থেকে চীনা নাগরিকদের জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, কারখানাগুলো ফের চালু হয়েছে।
সেপ্টেম্বরে চীনের রপ্তানি বেড়েছে ২৮ দশমিক ১ শতাংশ, যা প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি। তবে আমদানি আগের মাসের ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসে সেপ্টেম্বরে।
পশ্চিমের বহু দেশে লকডাউনবিরোধী বিক্ষোভ দেখা গেলেও অধিকাংশ চীনাই তাদের সরকারের 'জিরো কোভিড' কৌশল নিয়ে গর্ব করেছে। সরকারের এ নীতিকে তারা পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে।
কিন্তু ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখানোর পর চীন সরকারের প্রতি জনগণের প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে। এতই বেড়ে গেছে যে, নতুন একজন মানুষ সংক্রমিত হলেও গোটা জাতি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য কঠোরতম পদক্ষেপ নিতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। গত বুধবারই মঙ্গোলিয়া সীমান্তের কাছে, এরেনহট-এ একজন ব্যক্তি কোভিড পজিটিভ হওয়ায় গোটা শহরের সমস্ত স্কুল, সরকারি কার্যালয় ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লকডাউন দেওয়া হয়। রাতারাতি করোনা পরীক্ষা করা হয় শহরের সব বাসিন্দার।
বেইজিং উইন্টার অলিম্পিক শেষ হওয়ার আগে চীনের সীমান্ত খোলা হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। শীতকালীন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। তবে কিছু কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, এই কড়াকড়ি আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে, চলবে ২০০২ সালের শেষ দিকে কমিউনিস্ট পার্টির বিশতম সম্মেলন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। সে সময় শি জিনপিং তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
কিন্তু বাকি দেশগুলো একে একে নিজেদের সীমান্ত খুলে দিচ্ছে। চীন কি তাহলে সবার শেষে নিজেদের সীমান্ত খুলবে?
মহামারিকাল প্রেসিডেন্ট জিনপিং কিংবা তার পার্টির পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির ছয় সদস্যের কেউই দেশের বাইরে যাননি। নিকট-ভবিষ্যতেও কেউ যাবেন না বলেই অনুমান।
এ মাসের শুরুর দিকে জিনপিং ও জো বাইডেন চলতি বছরের শেষ দিকে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে মিলিত হতে সম্মত হয়েছেন। মহামারিকালে ভার্চুয়াল বৈঠক খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ ধরনের বৈঠকে মুখোমুখি বসে কথা বলার মতো বিশ্বাস ও আন্তরিকতা জন্মায় না।
চীনের নাগরিকদের দেশের ভেতরে ভ্রমণের ওপরও এখনও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ আছে। ভ্রমণে বের হওয়ার আগে প্রত্যেকে অনেকগুলো পরীক্ষা করাতে হয়, অসংখ্য কাগজপত্র জমা দিতে হয় এবং গন্তব্যে পৌঁছার পর কমপক্ষে তিন সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়।
চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন বিদেশি নির্বাহীকে দেশে ঢুকতে দিলেও তাদের সঙ্গী/সঙ্গিনী ও সন্তানদের ভিসা দেয়নি চীন সরকার। এর ফলে অনেকেই চীনে না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা ভিসা পাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা নিজ দেশে বসেই কাজ করবেন।
এরকম ভিসানীতি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে। এই নীতি নিয়ে চীন সরকারের ভাবা উচিত। নিজের দেশের বাইরে কাজ করা এমনিতেই যথেষ্ট কঠিন ও চাপের। তার ওপরে যদি প্রিয়জনদের সঙ্গে না আনা যায়, তাহলে সেই চাপ ও উদ্বেগ পাথরের মতো যে-কারও বুকের ওপর চেপে বসতে বাধ্য।
গত মাসে দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই দিনব্যাপী সভা করেছেন শি জিনপিং। সভার আলোচ্য বিষয়—চীনকে কী করে ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের মেধা-কেন্দ্রে পরিণত করা যায়। সেই উদ্দেশ্যে তিনি বিদেশি পেশাদারদের চীনে নিয়ে আসার জন্য আরও বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিদেশি মেধাবীদের সুযোগ দিতে হবে, তারা যেন প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে চীনে প্রবেশ করতে পারেন। তাহলেই কেবল চীন তাদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হবে।
- সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট