তানজানিয়া: করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন প্রত্যাখ্যান করছে যে দেশ
মাসের পর মাসজুড়ে পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া দাবি করে আসছিল যে, তাদের দেশ করোনার প্রভাব থেকে মুক্ত ফলে তাদের কোনরকম ভ্যাকসিনেরও প্রয়োজন নেই।
বিবিসির প্রতিনিধি সম্প্রতি সে দেশের একটি পরিবারের সাথে কথা বলে। স্বামী এবং পিতার মৃত্যুতে সেখানে আহাজারি চলছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, দুজনেরই করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে । শুধু এই পরিবারেই নয়, ধারণা করা হচ্ছে দেশটিতে অনেকেই অজ্ঞাতে এ রোগটি বয়ে বেড়াচ্ছেন!
পিটার (ছদ্মনাম) কাজ থেকে ফেরেন খুসখুসে কাশি নিয়ে। তিনি স্বাদগ্রহণের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিলেন। হাসপাতালে নেয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন পিটার। তবে মৃত্যুর আগে বা পরে তার কোভিড সনাক্তকরণ পরীক্ষা হয়নি।
তানজানিয়ার সরকারের ঘোষণা মতে, তারা "করোনাভাইরাস মুক্ত"। এখন পর্যন্ত সেখানে খুব বেশি সনাক্তকরণ পরীক্ষা হয়নি এবং পূর্ব আফ্রিকার এ দেশ জানিয়েছে তাদের টিকাদান কর্মসূচীরও কোন দরকার নেই।
ফলে সেখানে ভাইরাসের প্রকৃত মাত্রা নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। কেবলমাত্র অল্প সংখ্যক লোককেই বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
পিটারের স্ত্রীর মত সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া কিছু গণ বিবৃতি থেকে এটাই বোঝা যায় যে, দেশটির অনেক পরিবারেই ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
কয়েকটি তানজানিয়ান পরিবার শোকের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে কিন্তু সরকারের আক্রোশের ভয়ে তারা কেউ মুখ খুলে প্রতিবাদ জানায়নি।
ব্রিটিশ সরকার তানজানিয়া থেকে আসা সমস্ত ভ্রমণকারীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও করোনাভাইরাসের জন্য দেশটিতে ভ্রমণ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে।
ভ্যাকসিন বিতর্ক
তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলি যখন দেশটিকে কোভিড-মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করলেন, সেই গত বছরের জুন থেকেই তিনি এবং তার শীর্ষ কর্মকর্তারা মাস্কের কার্যকারিতা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছেন,সনাক্তকরণ পরীক্ষা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে্ন এবং প্রতিবেশী দেশগুলো নিয়ে হাসাহাসি করেছেন যারা ভাইরাস প্রতিরোধে নানাবিধ স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
কোনো প্রমাণ ছাড়াই করোনার টিকা মানুষের ক্ষতি করতে পারে বলেও প্রেসিডেন্ট কিছুদিন আগে সতর্ক করেন। বরং তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন ব্যতীতই তানজানিয়ার অধিবাসীদের ইনহেলেশন এবং ভেষজ ঔষধ গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেন।
প্রেসিডেন্ট ঠিক কী কারণে এই ভ্যাকসিনগুলো সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তা স্পষ্ট নয় তবে তিনি সম্প্রতি বলেন যে তানজানিয়ানদের 'গিনিপিগ' হিসাবে ব্যবহার করা উচিত নয়।
"যদি সাদা চামড়ার মানুষের পক্ষে এ রোগের টিকা আবিষ্কার সম্ভব হয়, তবে এতদিনে সে কেন এইডস, ক্যান্সার এবং টিবি'র টিকা কেন খুঁজে পেল না", বলেন মাগুফুলি ।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার এ বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি ভিন্ন মত পোষণ করে।
বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে তানজানিয়াকে পুরোপুরি সহযোগিতা করতে প্রস্তুত সেটি উল্লেখ করে এর আফ্রিকা অঞ্চলের পরিচালক মাতিশিদো মোতি বলেন, "করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন কার্যকর এবং আমি তাকে (তানজানিয়ান সরকার) একটি টিকাদান কর্মসূচীর জন্য প্রস্তুতি নেয়ার জন্য উৎসাহিত করব"।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডরোথি গওয়াজিমাও প্রেসিডেন্টের বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, "কোন ওষুধ কীভাবে গ্রহণ করা হবে সেটি নিয়ে আমাদের মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব প্রক্রিয়া রয়েছে এবং যেকোন ওষুধের ওপর পুরোপুরি আস্থা অর্জনের পরই আমরা সেটি গ্রহণ করি।"
তিনি এই সপ্তাহে একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে এই মন্তব্য করেন। একই ব্রিফিংয়ে একজন কর্মকর্তা আদা, পেঁয়াজ, লেবু এবং গোলমরিচ এর মিশ্রণে একটি পানীয় (স্মুদি) তৈরী করে দেখান যা করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করবে বলে তারা দাবি করেন। যদিও তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়।
গওয়াজিমা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে এবং প্রাকৃতিক ও দেশজ ওষুধ ব্যবহারের আহবান জানান।
তিনি বলেন যে, এর মানে এটি নয় ভাইরাসটি এ দেশে। তার বক্তব্য অনুযায়ী, তানজানিয়াবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে কারণ ভাইরাসটি তাদের প্রতিবেশি দেশের ওপর হানা দিয়েছে!
দেশটির কিছু চিকিৎসক সরকারের এমন বক্তব্যে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
"এখানকার সরকার বলছেন যে, শুধু কয়েক পদের শাকসবজি গ্রহণ করলেই ভাইরাস থেকে দূরে থাকা যাবে! শাকসবজির অবশ্যই নিজস্ব পুষ্টিগুণ রয়েছে তবে এর মানে এটি নয় যে তা করোনাভাইরাসের হাত থেকে সুরক্ষা দেবে সব সময়", বিবিসির কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন এক ডাক্তার।
গওয়াজিমা, প্রেসিডেন্ট এবং সরকারের আরও তিন শীর্ষ কর্মকর্তা একমাত্র দেশের কোভিড -১৯ সম্পর্কে তথ্য দিতে পারেন। কিন্তু নজিরবিহীনভাবে দেশটির ক্যাথলিক নেতারা সম্প্রতি তাদের নীরবতা ভেঙে এগিয়ে এসেছেন; তারা জনগণকে ভাইরাসের বিস্তার রোধে স্বাস্থ্যবিধিসমূহ পর্যবেক্ষণ করার জন্য সতর্ক করেছেন।
"কোভিড শেষ হয়নি, কোভিড এখনও এখানেই রয়েছে। আসুন আমরা বেপরোয়া না হয়ে নিজেদের জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসি। সর্বত্র মাস্ক পরিধানের অভ্যাসে ফিরে যাই", বলেন দার এস সালাম যুদা থাদেই রুওয়াইচি এর বিশপ।
তানজানিয়া এপিস্কোপাল কনফারেন্সের সেক্রেটারি, ফাদার চার্লস কিতিমা জানান, যে শহুরে এলাকাগুলোতে এখন আগের চাইতে মৃতের সংখ্যা অনেক বেড়েছে এবং অধিক পরিমাণে শেষকৃত্যের আয়োজন করতে হচ্ছে।
তবে কিছু কিছু মুহূর্তে ঠিকই ভাইরাসের উপস্থিতি স্বীকার করেছে তানজানিয়া সরকার।
জানুয়ারিতে ডেনমার্ক জানায় যে, তানজানিয়া সফরকারী দুইজন নাগরিক পজিটিভ সনাক্ত হয়েছেন এবং আগের চাইতেও অধিক সংক্রমনশীল দক্ষিণ আফ্রিকান ধরনটি বহন করছেন। তার পরপরই প্রেসিডেন্ট মাগুফুলি বাইরের দেশ থেকে 'করোনার নতুন ও অদ্ভুত ধরন' বয়ে নিয়ে আসবার জন্য তানজানিয়াবাসীকে দোষারোপ করেন।
এ ঘটনার পরেই দুটি হাসপাতাল পরিদর্শন করার শেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব অধ্যাপক মাবুলা মেকেম্বে বলেন যে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভোগা রোগীরা উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ এবং হাঁপানিতেই বেশি ভুগছিলেন, করোনার জন্য নয়!
- বিবিসি অবলম্বনে