দায়িত্ব পালনকালে অসুস্থ বা অক্ষম হয়ে পড়া মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা
অসুস্থতা রাষ্ট্রপতি হিসেবে একজনের সক্ষমতা বহুলাংশে কমায়। মার্কিন প্রেসিডেন্টরাও তো আর অতিমানব নন। কালে-ভদ্রে তারাও পড়েছেন এ বিপাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে রাষ্ট্রপতিদের শারীরিক অবস্থায় বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার আইনও বেশ সহজ ছিল, ঐতিহাসিকভাবেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জনকরাও রাষ্ট্রক্ষমতায় একটি ধারাবাহিক উত্তরাধিকার থাকার গুরুত্ব শুরুতেই অনুধাবন করেছিলেন।
তাই দেশটির সংবিধান অনুসারে দায়িত্বপালনকালে একজন রাষ্ট্রপতি মারা গেলে, অসুস্থ হলে বা পদত্যাগে বাধ্য হলে ভাইস প্রেসিডেন্টকেই তার দায়িত্বভার গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে।
অবশ্য এ আইনে কিছু ফাঁক রয়েছে। যেমন, সাবেক রাষ্ট্রপতি সুস্থ হলে কীভাবে তার কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হবে বা ঠিক কতদিন পর তিনি দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য হবেন- তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি।
জন এফ কেনেডির মৃত্যুর পর মার্কিন কংগ্রেস পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে, যার আওতায় প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের মৃত্যু বা শারীরিক অক্ষমতার মুহূর্তে তাদের প্রশাসনিক উত্তরসূরীদের ক্ষমতাগ্রহণের বিধিমালা চালু করা হয়।
দুই শতাব্দীকালের মার্কিন গণতন্ত্রের ইতিহাসে অসংখ্যবার ঘটেছে প্রেসিডেন্টদের অসুস্থ থাকা বা মৃত্যুর ঘটনা। নির্ধারিত সময়ের আগে ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হওয়া সেই রাষ্ট্রনায়কেরাই এ আলোচনার বিষয়বস্তু।
জর্জ ওয়াশিংটন:
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দানকারী জর্জ ওয়াশিংটন। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৭ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তবে তিনিই প্রথম অসুস্থতার কারণে সাময়িক ক্ষমতা ত্যাগকারী প্রথম রাষ্ট্রপতি।
১৭৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাত্র মাস দুয়েক পরই তার শরীর থেকে শল্যপাচারের মাধ্যমে একটি টিউমার অপসারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অপারেশনের পর টানা ছয় সপ্তাহ বিশ্রামে থাকতে হয় তাকে।
এছাড়া, ক্ষমতায় থাকার দ্বিতীয় বছরে সেই সময়ের প্রাণঘাতি এক ইনফ্লুয়েঞ্জা জীবাণুতে আক্রান্ত হন ওয়াশিংটন। এতে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হারানোর উপক্রম হয়।
ওই সময় নিজের বেঁচে থাকা নিয়েই সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
''এক বছরের কম সময়ে আমি দুইবার ইনফ্লুয়েঞ্জার কবলে পড়েছি। প্রথমবারের চাইতে পরেরটাই বেশি ভোগাচ্ছে। তৃতীয়বার আক্রান্ত হলে আমাকে হয়তো আমার পূর্বপুরুষদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে,'' বলেছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা উত্তরকালে নানাবিধ রোগ-ব্যাধির বড় প্রাদুর্ভাব ছিল। ১৭৯৩ সালে পিতজ্বরের এক প্রাদুর্ভাবের কারণে ওয়াশিংটন এবং তার সরকার গ্রাম্য এলাকায় পালাতে বাধ্য হয়।
সে যাত্রায়ও বেঁচে যান ওয়াশিংটন। জীবদ্দশায় তিনি ডিপথেরিয়া, যক্ষ্মা, গুটি বসন্ত, ম্যালেরিয়া এবং ডায়েরিয়ার মতো সেকালের বেশ কিছু প্রাণ সংহারক রোগ থেকে বেঁচে গেছেন।
যুদ্ধক্ষেত্রের অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ মুহূর্তের মতোই রোগের সঙ্গে লড়ে টিকে গেছেন তিনি। তবে ক্ষমতা ছাড়ার পর তিনি কণ্ঠনালীর এক সংক্রমণে মারা যান।
উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন:
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সময় দায়িত্ব পালন করার রেকর্ড উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসনের। শপথ গ্রহণের দিন তিনি নিউমোনিয়ার জীবাণুতে সংক্রমিত হন। এরপর মারা যান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র ২৪ দিনের মাথায়। দায়িত্বরত অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী তিনিই ছিলেন প্রথম মার্কিন রাষ্ট্রপতি।
ওই সময়ে, ভাইস প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নেওয়ার কোনো নিয়ম ছিল না। তবে প্রতিনিধি পরিষদ উপ-রাষ্ট্রপতি জন টাইলর'কে পরবর্তীকালে ক্ষমতা অধিগ্রহণের অনুমোদন দেয়।
গ্রুভার ক্লিভল্যান্ড:
১৮৯৩ সনে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি গ্রুভার ক্লিভল্যান্ডের মুখে একটি ক্যান্সার আক্রান্ত টিউমার অপসারণ করার দরকার পড়ে। গণমাধ্যমের নজর এড়াতে নিজ বন্ধুর এক প্রমোদতরীতে টিউমারের শল্যপাচার করান তিনি।
অস্ত্রোপচারের কারণে তার স্বাদগ্রন্থীর প্রায় অর্ধেক কেটে ফেলেন চিকিৎসক। এর বদলে একটি কৃত্রিম অঙ্গ লাগিয়ে দেন। ওই অবস্থাতেই নিজ দায়িত্ব পালনে ফেরেন তিনি। আর জনগণ এই বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি।
উড্রো উইলসন:
১৯১৮ সালে প্যারিস শান্তি আলোচনায় অংশ নেওয়ার কালে 'স্প্যানিশ ফ্লু' নামক অতিমারির কবলে প্রায় মরতে বসেছিলেন উড্রো উইলসন।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে ওই মহামারিতে প্রায় ২ কোটি মানুষ মারা যায় বিশ্বব্যাপী। তবে প্রেসিডেন্টের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছ থেকে গোপন রাখে যুক্তরাষ্ট্র। তার চিকিৎসক জানান, তিনি প্যারিস সফরকালে সামান্য সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়েছেন।
এ অসুস্থতা উইলসনকে মারাত্মক ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের অধিকারীতে পরিণত করে। অন্যান্য বিশ্বনেতার সঙ্গে তার দর কষাকষি এবং আলোচনার ক্ষমতাও কমে যায় এর ফলে। এ সময় ফরাসি নেতা জর্জ ক্লেমেনসিওর দাবি মেনে যুদ্ধে পরাজিত জার্মানির রাইনল্যান্ড প্রদেশের বেসামরিকীকরণ এবং সেখানে ১৫ বছর ফরাসি দখলদারিত্বের শর্ত মেনে নেন উইলসন।
তার সম্মতির ফলে ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানিকে অপদস্থ করা হয়, যা পরবর্তীকালে হিটলারের মতো স্বৈরশাসকের জন্ম দেয়।
তবে সেটাই শেষবার তার অসুস্থতার ঘটনা নয়। পরের বছর, ১৯১৯ সালেও অসুস্থ হন উইলসন। তখন তার মন্ত্রীসভা ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পক্ষে অভিমত দেয়। তবে প্রেসিডেন্টের চিকিৎসক এবং তার স্ত্রী সেই দাবি মেনে নেননি।
এছাড়াও, ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার, ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, রোনাল্ড রিগ্যান এবং জর্জ ডব্লিউ বুশ অসুস্থতার কারণে তাদের ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে কিছুদিনের জন্য ক্ষমতা অর্পন করেছিলেন।
- সূত্র: হিস্টোরি ডটকম