নিউরো ও মনোবিজ্ঞান বলছে এবার আকস্মিক জয়লাভ করতে পারবেন না ট্রাম্প
২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একদিন। এদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মার্কিনীরা জানতে পারেন তাদের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আসছে নভেম্বরে আবারও কী তেমন বিস্মিত হতে হবে আমার দেশবাসীকে!
প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ এবং তার উপর সমগ্র জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে।
২০১৬ সালে ট্রাম্পের বিজয় ছিল যেমন হতবাক করে দেওয়ার মতো, ঠিক তেমনটাই অপ্রত্যাশিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং মতামত জরিপের অধিকাংশ তা অনুমানে ব্যর্থ হয়। খোদ ট্রাম্পই বিস্মিত হয়েছিলেন ফলাফলে।
পরবর্তীতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, বিশাল ব্যবধানে পরাজয় শঙ্কা করে তিনি সেদিন লজ্জিত, বিব্রত হওয়ার প্রমাদ গুনেছিলেন।
২০১৬ সালে ট্রাম্পের বিজয় অনেকে আঁচ না করতে পারলেও, আমি কিন্তু ঠিকই তার পূর্বাভাস দিয়েছিলাম। ওই একই দৃষ্টিকোণ থেকে এবারের অবস্থাকেও দেখা যেতে পারে। নিউরোসায়েন্স অনুসারেই এমন ফলাফল প্রত্যাশা করেছিলাম। আশার কথা হচ্ছে, এবার ট্রাম্পের জন্য আকস্মিক বিজয়ের তেমন যুক্তি দিচ্ছে না মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের শাখাটি।
ট্রাম্পের বিজয় নিয়ে প্রথম লেখাটিতে আমি মস্তিষ্কের দুইটি প্রধান কার্য-প্রক্রিয়া তুলে ধরি। এরমধ্যে একটি হলো; আমাদের সচেতন চিন্তা শক্তি- যা নিয়ন্ত্রিত এবং স্পষ্ট। অন্যটি হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়। এবং তা আবেগ-অনুভূতি দ্বারা তাড়িত। এখানে ভয়ের মতো অনুভূতি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় বড় প্রভাব ফেলে।
ট্রাম্প সেবছর নির্বাচনী প্রচারণার যে কৌশল নিয়েছিলেন, তা যুক্তি বিশ্লেষণের কাজে নিয়োজিত মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স গ্রন্থিতে প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু, এটা ভোটারদের মগজের স্বয়ংক্রিয় অংশকে নাড়া দেয়।
মনস্থির না করা অসংখ্য ভোটার; এধরনের ভয় তাড়িত হয়ে হঠাৎ করেই ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে বসেন। আসলে এ প্রতিক্রিয়া তাদের মধ্যে কাজ করা সহজাত অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা আর উদ্বেগের ফসল। একারণে, নির্বাচন পরবর্তীকালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিংহভাগ ভোটারই কেন তারা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন- তার যথাযথ এবং স্থির যুক্তি দেখাতে পারেননি।
ট্রাম্প ২০২০ সালে নির্বাচনী প্রচারণাতেও মগজের সেই ভীতি শনাক্ত করার সার্কিটে লক্ষ্যস্থির করেছেন। ভোটাররা অনুভূতি পরিচালিত হয়ে তারা ট্রাম্পের প্রতি আকৃষ্ট হবেন এবং তার প্রতিপক্ষ ঘায়েল হবে, এমন কৌশল আবারও নিয়েছেন তিনি।
''বাইডেন জিতলে দেশের নিয়ন্ত্রণ হিংস্র বামপন্থীদের হাতে চলে যাবে। যদি বাইডেন জেতেন, তাহলে চীন জিতে যাবে। বাইডেন জিতলে উচ্ছৃঙ্খল জনতা জিতবে। সে জিতলে বিজয় হবে; দাঙ্গাবাজ, লুঠপাট আর অগ্নিসংযোগকারীদের। যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পুড়িয়েছিল প্রকাশ্যে, বিজয় তাদেরই হবে,'' গত ১৭ সেপ্টেম্বর উইসকনসিনে আয়োজিত এক নির্বাচনী র্যালিতে এমন কথা বলেছেন ট্রাম্প।
একথা সেই ২০১৬ সালের নির্বাচনী কৌশলের প্রতিধ্বনি, যেখান থেকে তার অবস্থান একটুও পরিবর্তন হয়নি। ওই সময় তিনি বিজয়ী না হলে; দেশ ধর্ষক অভিবাসী আর বিদেশি সন্ত্রাসীতে ভরে যাবে, বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন রিপাবলিকান দলের তৎকালীন এ প্রার্থী। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অভিবাসন নিয়ে নাগরিক মনোভাব পরিবর্তন হওয়ায়, তিনি একটু অন্য ধরনের ভীতি তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে আরেক তাৎপর্যময় ঘটনা। প্রেসিডেন্ট বারবার আনন্দোলনকারীদের সহিংস দাঙ্গাবাজ আখ্যা দিয়ে আসছেন। এর প্রতি সমর্থন থাকায় ডেমোক্রেট দলের তীব্র নিন্দাও করেছেন।
যেভাবে তিনি বিশৃঙ্খলা এবং সড়কে হানাহানির হুমকি তুলে ধরছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে; কোনো দলের সমাবেশে এমন সহিংস ঘটনা ঘটলেই- তার ফলে ট্রাম্পের ভয় সৃষ্টিকারী কৌশল শক্তিশালী হবে। হয়তো একারণেই সহিংসতা তৈরির জন্য উস্কানি দিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প সমর্থকেরা। কিছু সমাবেশে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র হাতেও সমবেত হতে দেখা গেছে।
২০১৬ সালে প্রচারণার সময় ট্রাম্প তার সমর্থকদের সহিংস হয়ে উঠতে ক্রমাগত উস্কানি দেন। এমনকি হিলারি ক্লিনটন যদি আগ্নেয়াস্ত্র অধিকার গোষ্ঠীর কোনো সদস্যের হাতে নিহত হন, তাহলে তিনি সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ দিতে পারবেন না- এমন কথাও বলেছিলেন।
চলতি বছরেও বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে সেখানে সামরিক বাহিনী এবং কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা রক্ষীদের মোতায়েন করে; তিনি আরও সহিংসতা সৃষ্টির চেষ্টা চালান। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অসম্মতি সত্ত্বেও তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করেছেন।
বিস্ফোরক মন্তব্যও লাগাতার চলছে। মিনেসোটায় দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ''মার্কিন জাতীয় জীবনের স্বপ্ন আর বিশৃঙ্খলার মাঝে বাধা দেওয়ার আমিই শেষ দেওয়াল। চলতি বছরের প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে তার এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বিতর্ক পরিচালনাকারী সঞ্চালক ক্রিস ওয়ালেস জিজ্ঞাসা করেন, তিনি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কীর্তিকালাপের নিন্দা করবেন কিনা?
ট্রাম্প এ প্রস্তাবে সাড়া দেননি। বরং 'প্রাউড বয়েজ' নামক এধরনের একটি গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।
অস্থিতিশীলতা এবং ভীতির আবহ তৈরির এমন চেষ্টা অবশ্য এবার মার্কিন জনতাকে খুব বেশি প্রভাবিত করবে বলে মনে হয় না। কারণ তারা অতিমারির কারণে; যুক্তি এবং অভিজ্ঞতা থেকে শেখা শুরু করেছেন। আর মস্তিষ্কে যুক্তির সঙ্গে যুক্ত অংশটিই আমাদের ভীতি কাটিয়ে কোনো পরিস্থিতি বিশ্লেষণে সাহায্য করে থাকে। ওই অবস্থায় ভয় যদি যুক্তি বিবর্জিত হয়, তাহলে মস্তিষ্ক সেখানে সাড়া দেয় না।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শাসনকালে যুক্তরাষ্ট্র ভয়ের রাজনীতি পরিচালিত দেশ ছিল না।
একারণেই, বাইডেন প্রার্থী হওয়ার সময় যখন ট্রাম্প বলেছিলেন যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপ দেবেন- তা মানুষের মনে ভয় জাগাতে পারেনি। কারণ, মার্কিনীরা দেখেছে স্বঘোষিত সমাজবাদী বার্নি স্যান্ডার্সকে পরাজিত করেই ডেমোক্রেট দলের মূল প্রার্থীতার দৌড়ে বিজয়ী হয়েছেন জো বাইডেন।
মনোবিজ্ঞান এবং নিউরোসায়েন্স প্রথম বিতর্কের সময়ে প্রতিপক্ষের প্রতি ট্রাম্পের ক্রমাগত বিদ্রূপ এবং গালাগালি করার দিকেও আলোকপাত করে। ওই বিতর্কের পরিচালকে পাত্তাই দেননি তিনি। অসংযত বক্তব্য দিয়েই গেছেন প্রতিপক্ষের কথার মধ্যে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
অথচ প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে বিতর্ক আয়োজনের উদ্দেশ্য হচ্ছে; তাদের মস্তিষ্কের যুক্তির অংশটাকে সক্রিয় করা। তার মাধ্যমে দর্শকদের কাছে নানা বিষয়ে তাদের নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করা। যার বিপরীতে ট্রাম্প বিতর্ক প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করে ভীতির স্রোত বইয়ে দেওয়া স্বয়ংক্রিয় অংশটিকে সক্রিয় করতে চেয়েছেন।
ট্রাম্প আসলে আবেগের সমর্থনে নির্বাচিত হয়েছেন। এবং তিনি সমর্থকদের সেই চিন্তা-ধারাকেই শক্তিশালী রাখতে চান। এজন্যেই,তিনি সামরিক বাহিনীর জেনারেল, উচ্চ-পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বা বিজ্ঞানীদের পরামর্শ মাফিক সিদ্ধান্ত নেন না। এর মাধ্যমে সমর্থক জনতার আবেগ অংশের প্রতি- তিনি এক প্রকার সাহায্য আবেদনের সংকেত পাঠান এবং তাদের প্রভাবিত করতে সমর্থ হন। এটা পরস্পরের প্রতি সরাসরি নির্ভরতার সম্পর্ক।
এই সম্পর্কের অংশীদার; চিন্তাশক্তি রহিত অন্ধ-সমর্থকদের বাইরে- এখন ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা অতোটা শক্তিশালী নয়। তিনি যুক্তিতে সাড়া দেন না। জলবায়ু পরিবর্তন, মার্কিন নির্বাচনে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ, অতিমারি- কোনো ইস্যুতেই বাস্তবসঙ্গত তথ্যপ্রমাণ তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারেনি। আর যুক্তি অবহেলা করে একের পর এক বিপর্যয় সৃষ্টির ট্রাম্পের এ মানসিকটা এখন বেশ ভালো করেই অনুভব করছে মার্কিন জনতা।
- লেখক পরিচিতি: আর. ডগলাস ফিল্ডস যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউড অব হেলথ সেকশন অন নার্ভাস সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্লাস্টিসিটির একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক। তিনি 'ইলেকট্রিক ব্রেইন: হাউ দ্য নিউ সায়েন্স অব ব্রেনওয়েভস রিডস মাইন্ডস' শীর্ষক একটি বিখ্যাত বইও লিখেছেন।
- সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান