পশ্চিমবাংলায় বিজেপির সর্বাত্মক অভিযান, মোদি-শাহ তারপরও কেন ব্যর্থ?
পশ্চিমবাংলায় রাজ্য পর্যায়ের নির্বাচন হয় আট ধাপে। গত ১২ এপ্রিল রাজ্যের এক জনসভায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, "প্রথম চার ধাপে ভোটের জোয়ারে তৃণমূল ভেসে গেছে। মানুষ এবার বিজেপির পক্ষে এত বেশি চার-ছক্কা মেরেছে, যার ফলে এরমধ্যেই বিজেপি সেঞ্চুরি স্কোর করে ফেলেছে।"
এক সপ্তাহ পর গত ১৮ এপ্রিল বিজেপির শীর্ষ নেতা ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, প্রথম পাঁচ ধাপের ১৮০টি নির্বাচনী আসনে ১২২টিতেই জিতবে তার দল।
"মমতা ব্যানার্জির পরাজয় আসন্ন। তিনি দশ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন, তাই সাদামাটা বিদায় তাকে জানানো একেবারেই উচিৎ হবে না। মহা-পরাজয়ের মাধ্যমেই তাকে বিদায় হতে হবে আর আমি সকলকে আশ্বস্ত করছি, চূড়ান্ত ফলাফলে বিজেপি ২০০- এর অধিক আসন পাবে," শাহ যোগ করেন।
তারপর সরাসরি চলে আসা যাক চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার দিন আজ ২ মে'তে, যেদিন বিজেপির নিশ্চিত আশার সম্পূর্ণ বিপরীত ফলাফল দিয়ে আরও একবার চমক লাগাল বাংলার জনতা।
ফলে চলতি বছরেই পশ্চিমবাংলায় বিজেপির সরকার গঠনের অভিলাষ সম্পূর্ণরূপে নস্যাৎ হয়েছে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে, যেখানে জানানো হচ্ছে; মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিশাল ব্যবধানে জয়ের কথা। ফলে তৃতীয়বারের মতো মমতার দখলেই থাকছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যটির মসনদ।
বিকেল ৩টা নাগাদ নির্বাচন কমিশনের গণণা অনুসারে অন্তত ২০০-এর বেশি আসনে নিশ্চিত জয় নিয়ে এগিয়ে আছে তৃণমূল, সেই তুলনায় বিজেপি এগিয়ে মাত্র ৭৭টিতে।
ফলাফলে 'গণেশ উল্টে' যাওয়ার হালই যেন বিজেপির। তবে তারপরও বলতে হয় ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের চেয়ে এবার বিজেপি অনেক উন্নতি করেছে, কিছুদিন আগেও পশ্চিমবাংলায় তারা নগণ্য রাজনৈতিক শক্তি হলেও, এবার তারা প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠেছে কংগ্রেস এবং কম্যুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই- মার্ক্সিট) এর মতো পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দলকে পেছনে ফেলে।
তবে বাংলা জিততে আগ্রাসী নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েও জিততে না পারাটাকে 'বড় রকমের ব্যর্থতা' বলে স্বীকার করেছেন বিজেপির একাধিক নেতা।
আনুষ্ঠানিক এক বিবৃতিতে বিজেপি জানায়, "আমরা পরাজয় মেনে নিচ্ছি"- কিন্তু একইসঙ্গে মমতার প্রতি একহাত নেওয়া হয় সেখানেও- "আমরা নিজেদের সবটুকু শুভ শক্তি কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছি, তারপরও পরাজিত হয়েছি অর্থলোভী ও অসৎ নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কারণে, মমতা যাদের কালো টাকা দিয়ে তৈরি করেছেন। তবুও বলব, ২০১১ ও ২০১৬ সালের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে আমাদের শক্তি ও ভোট অনেক বেড়েছে," বলছিলেন বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র আর.পি. সিং।
ভুল কোথায় ছিল:
দুই বছর আগে থেকে এবার পশ্চিমবাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে বিজেপি। এই রাজ্যের শাসন ক্ষমতা পাওয়া সহজ হবে না জেনেই কৈলাস ভিজয়ভার্গিয়া, শিব প্রকাশ এবং অরবিন্দ মেননের মতো জ্যেষ্ঠ নেতাদের সেখানে মাঠ প্রস্তুতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজ্য বিজেপি প্রধান দিলীপ ঘোষসহ এসব নেতা পুরো রাজ্য চষে বেড়িয়েছেন সংগঠনের শক্তি বাড়াতে।
২০২১ সালর নির্বাচনী প্রচারণার কালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এসেও একাধিক জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রমতে, শাহ অন্তত ৫০টি বৈঠক, র্যালি এবং রোড শো'তে বক্তব্য দেন। অন্যদিকে, সরাসরি ও ভার্চুয়াল ব্যবস্থায় অন্তত ২০টি ভাষণ দেন নরেন্দ্র মোদি।
এছাড়া, বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের আরও অনেক প্রভাবশালী সদস্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী- স্মৃতি ইরানী, রাজনাথ সিং এবং ধর্মেন্দ্র প্রধানের মতো নেতারাও প্রচারণায় যোগ দেন। কিছু সভায় হাজির ছিলেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। বিজেপি'র সভাপতি জয়প্রকাশ নাড্ডাও ৪০টির বেশি সম্মেলনে বক্তৃতা দেন।
এছাড়া, লকেট চ্যাটার্জি এবং স্বপন দাশগুপ্তের মতো এমপিদের মনোনয়ন দেয় বিজেপি, এসব প্রার্থী তৃনমূলের দুর্গ বলে পরিচিত আসনে শক্ত লড়াই সৃষ্টি করতে পারবেন বলে বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতারা আশা করেন। তাছাড়া, একেবারে শেষ পর্যায়ের চমক হিসেবে মিথুন চক্রবর্তীকেও দলে ভেড়ানো হয়। প্রস্তুতিতে কোনো কার্পণ্য ছিল না দলটির।
আর বিজেপির আশার প্রদীপের সলতে উস্কে দেয় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল। ওই নির্বাচনে রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ১৯টিতে জয় পায় বিজেপি। সেই তুলনায় ২০১৪ সালে তারা পেয়েছিল মাত্র ২ আসন।
তবে শেষমেষ হারের কারণ হিসেবে নির্দিষ্ট কোনো মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী না থাকা এবং মমতাকে অতি-প্রাধান্য দেওয়াকেই তারা দুষছেন।
এছাড়া, নন্দীগ্রামে প্রচারণার কালে একটি দুর্ঘটনায় পড়ে গিয়ে পায়ে আঘাত পান মমতা, তৃণমূল বলেছে তাকে ইচ্ছে করেই ভিড়ের ভেতর ধাক্কা দেওয়া হয়, এই ঘটনাও মমতার অনুকূলে কাজ করেছে।
নির্বাচনী প্রচারণার সম্পূর্ণ মেয়াদ জুড়ে তৃনমূলের প্রধান কৌশলবিদ প্রশান্ত কিশোর বার বার বলেছেন, রাজ্যের ২৯৪ আসনের মধ্যে এবার বিজেপি ১০০-এর বেশি আসনে জয়লাভ করতে পারবে না।
এব্যাপারে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্টকে নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিজেপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, "আসলে বিহারের মতোই পশ্চিমবাংলাতেও নীরব ভোটারদের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করেছে বিজেপি, তাছাড়া সিংহভাগ নারী ভোটার আমাদের সমর্থন করবেন বলে অনুমান করা হয়েছিল।"
জ্যেষ্ঠ ওই নেতা আরও বলেন, "ফলাফল ঘোষণার কাজ চললেও একটা ব্যাপার নিশ্চিত, প্রত্যাশা অনুযায়ী সমর্থন লাভে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। একইসময়ে, মমতা ব্যানার্জির কারিশমা কাজে লেগেছে।"
- সূত্র: দ্য প্রিন্ট থেকে অনূদিত