প্যারাগন: স্মার্টফোন হ্যাকের জন্য মার্কিন অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েলি সার্ভেইল্যান্স স্টার্টআপ
প্যারাগন সলিউশনসের কোনো ওয়েবসাইট নেই। অনলাইনে তাদের ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্যও নেই। যদিও তেল আবিবভিত্তিক স্মার্টফোন নজরদারি স্টার্টআপটির কর্মীরা লিঙ্কডইনে ছড়িয়ে আছেন। স্টার্টআপটির কর্মী সংখ্যা ৫০ জনের বেশি। যে প্রতিষ্ঠান এখনও গোপনে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তার জন্য এই সংখ্যা মোটেই কম নয়।
তবে স্টার্টআপটির সহপ্রতিষ্ঠাতা, পরিচালক ও প্রধান শেয়ারহোল্ডারের নাম শুনলে আপনার মাথা ঘুরে যাবে। এহুদ স্নিয়রসন—সাবেক ইসরাইলি কমান্ডার। এনএসএর সমমানের ইউনিট ৮২০০-এর কমান্ডার ছিলেন তিনি। বাকি তিন সহপ্রতিষ্ঠাতা—সিইও ইদান নুরিক, সিটিও ইগর বোগুদলভ ও গবেষণা শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াদ আব্রাহামও সাবেক ইসরায়েলি গোয়েন্দা। স্টার্টআপটির বোর্ডে আরও আছেন প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক ও ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক।
প্যারাগন সলিউশনসের প্রধান আর্থিক সহায়তাকারী হলো বোস্টনের ম্যাসাচুসেটসভিত্তিক ব্যাটারি ভেঞ্চারস। জানা গেছে, ব্যাটারি ভেঞ্চারস প্যারাগনে ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
প্যারাগনের দাবি, তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, ফেসবুক মেসেঞ্জার, জিমেইলসহ যেকোনো এনক্রিপ্টেড যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকে পড়া যাবে। প্যারাগনের স্পাইওয়্যার যেকোনো ডিভাইসে দীর্ঘস্থায়ী অ্যাকসেস নিতে পারে বলে জানা যায়।
২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত স্টার্টআপটি এমন এক সময়ে কার্যক্রম শুরু করছে, যখন স্মার্টফোন হ্যাকিং শিল্প তোপের মুখে আছে। কিছুদিন আগেই ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি করার তথ্য ফাঁস করে তোলপাড় ফেলে দিয়েছে পেগাসাস প্রজেক্ট। স্পাইওয়্যারটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ অবশ্য দাবি করেছে, ফাঁস হওয়া ফোন নম্বরগুলোর ওপর তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে নজরদারি করা হয়েছিল, এমন কোনো প্রমাণ নেই।
পেগাসাস প্রজেক্টের তদন্ত প্রকাশ্যে আসার আগেই মাইক্রোসফট প্রেসিডেন্ট ব্র্যাড স্মিথ সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ১২ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যের হ্যাকিংয়ের-মাধ্যমে-নজরদারির খাতটি সবার জন্যই হুমকি। তিনি লিখেছিলেন, এই খাতটি সাইবার নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি।
প্যারাগনের একজন সিনিয়র নির্বাহী ফোর্বসকে বলেন, তিনি তাদের পণ্য সম্পর্কে কথা বলতে চান না। তিনি জানান, তাদের কোম্পানির এখনো কোনো গ্রাহক নেই। তবে ওই কর্মকর্তার দাবি, এনএসওর মতো ঝামেলা এড়াতে প্যারাগন কেবল সেসব দেশের কাছেই প্রযুক্তি বিক্রি করবে, যারা আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে এবং জনগণের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে সম্মান করে। তিনি আরও বলেন, কর্তৃত্ববাদী বা অগণতান্ত্রিক সরকার কখনোই তাদের গ্রাহক হতে পারবে না।
এ শিল্প সংশ্লিষ্ট দুটি সূত্র ফোর্বসকে জানিয়েছে, প্যারাগন একটি ডিভাইসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না নিয়ে কেবল মেসেজিং অ্যাপগুলোতে প্রবেশাধিকার পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, প্যারাগনের স্পাইওয়্যার এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড অ্যাপগুলোর প্রটোকল ব্যবহার করে কাজ করে। অর্থাৎ এটি মেসেজিং সফটওয়্যার চালানোর মূল অংশের দুর্বলতাকে ব্যবহার করে ডিভাইস হ্যাক করে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের কেউ আগে এনএসও-তে কাজ করত, কেউ কাজ করত ইসরায়েলের গোয়েন্দা বিভাগে।
আমেরিকান অর্থে ইসরায়েলি নজরদারি
একজন আমেরিকানের সাহায্যে মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছার চেষ্টা করছে প্যারাগন। এনএসওসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্য এ কাজে ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা বিভাগে ৩০ বছর কাজ করা মেনাকেম পাকম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রাহক খোঁজার জন্য। অবশ্য এখন পর্যন্ত আটলান্টিক অঞ্চলে প্রতিষ্ঠানটি কোনো গ্রাহক পেয়েছে বলে জানা যায়নি।
ব্যাটারি ভেঞ্চারসের ইসরায়েলভিত্তিক প্রেসিডেন্ট অ্যারন রিনবার্গ প্যারাগনের বোর্ড উপদেষ্টা। তার মাধ্যমেই ব্যাটারি ভেঞ্চারস প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করেছে বলে জানা গেছে। ব্যাটারি অবশ্য ইসরায়েলি স্মার্টফোন নজরদারি প্রতিষ্ঠানটিতে তাদের বিনিয়োগের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঙ্ক স্কুলের সিটিজেন ল্যাবের সিনিয়র গবেষক জন স্কট রেইলটন বলেছেন, প্যারাগন যদি আমেরিকানদের ওপর নজরদারি করার জন্য আমেরিকান সংস্থাগুলোকে সাহায্য করতে চায়, তাহলে তাদের ব্যাপারে ব্যাপক তদন্ত করা দরকার। অবশ্য প্যারাগনের নির্বাহী বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটি তাদের ভবিষ্যৎ-গ্রাহকদের পরিচয় প্রকাশ করবে না।
প্যারাগনই মার্কিন অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইসরায়েলি কোম্পানি নয়। এর আগে মার্কিন অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে টোকা। এ প্রতিষ্ঠান আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ফরেনসিক বিশ্লেষণের জন্য ডিভাইস হ্যাক করতে সাহায্য করে। এছাড়া এনএসও-র বেশিরভাগ মালিকানাও মার্কিন প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সিসকো পার্টনার্সেরই ছিল। পরে তাদের জায়গা নেয় যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান নোভালপিনা ক্যাপিটাল।
প্যারাগনের নেতৃত্বে যারা আছেন, তারা সাইবার নিরাপত্তা ও সাইবার হামলা নিয়ে কাজ করে, এমন দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের হয়েই কাজ করেছেন। প্যারাগনের প্রধান নির্বাহী নুরিক হান্টার্স.এআই-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা। এই স্টার্টআপটির কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কোনো নেটওয়ার্কে হ্যাকারদের খুঁজে বের করা। স্নিয়রসন জেকঅপস-এর বোর্ড সদস্য ও উপদেষ্টা। অতীতে এই কোম্পানি নজরদারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত বেশ কিছু ফোন হ্যাকের ঘটনা ফাঁস করেছে।
সূত্র: ফোর্বস