প্রিন্সেস লতিফা: এক নিরুদ্দিষ্ট রাজকন্যার উপাখ্যান
রাজকন্যা লতিফার অপহরণ ও তাকে গোপনে আটকে রাখার ব্যাপারে নতুন নাটকীয় বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে।
বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে টিনা জওহায়েনের সাথে তার বন্ধুর শেষ যোগাযোগের পর।
পালানোর চেষ্টা করার পর দুবাইয়ে কারাবন্দী প্রিন্সেস লতিফা তার গোপন ফোন ব্যবহার করে কিছু সময়ের জন্য টিনার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
টিনা যখন লতিফাকে শেষবার দেখেছিলেন তখন ভারত মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় তারা একটি ইয়টের ডেকে শুয়ে তারা দেখছিলেন।
সময়টা ছিল ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, তারা লতিফাকে দুবাই থেকে বের করে ভিনদেশে নতুন জীবন শুরু করার দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করেন।
দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের ২৫ সন্তানের মধ্যে একজন এই প্রিন্সেস লতিফা।
শেখ আমিরাতকে চাকচিক্যময় এক নগরে রূপান্তরিত করলেও, আমিরাতের নারীদের জন্য দেশটির আইন ও রীতিনীতি তাদের জীবনকে সীমাবদ্ধ করে দুঃসহ করে তোলে।
"আমার গাড়ি চালানোর অনুমতি নেই, দুবাই ভ্রমণ বা দুবাই ত্যাগের অনুমতিও নেই আমার," পালিয়ে যাওয়ার আগে রেকর্ড করা একটি ভিডিওতে বলেছিলেন লতিফা।
"২০০০ সালের পর থেকে আমি দেশ ছাড়িনি। আমি শুধু ভ্রমণের, পড়াশোনার ও যে কোনো সাধারণ কাজ করার অনুমতি চেয়েও পাইনি। তারা আমাকে কিছুই করতে দেয়নি। এই জায়গা ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে।"
টিনার অ্যাপার্টমেন্টে বসে সামনে কী অপেক্ষা করছে তা নিয়ে বেশ প্রফুল্লভাবে কথা বলছিলেন লতিফা।
"ভবিষ্যত নিয়ে ইতিবাচক বোধ করছি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিজের খেয়াল খুশি মতো কিছু করতে পারবো, আমি জানি না কেমন অনুভূতি হবে আমার। আমি সত্যিই এমন সময়ের অপেক্ষায় আছি।"
লতিফার কাছে তার পাসপোর্টও ছিল না, কড়া নজরদারির মধ্যে ছিলেন তিনি। তাই তাদের দুবাই থেকে বের হয়ে গাড়ি চালিয়ে ওমান উপকূলে পৌঁছাতে হয়। ডিঙ্গি এবং জেট স্কি চালিয়ে তারা আন্তর্জাতিক জলসীমানায় প্রবেশ করেন। সন্ধ্যা নাগাদ তারা তাদের সেই ইয়টে পৌঁছান, যে ইয়টে করে তাদের স্বাধীনতা বুঝে নেওয়ার পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন তারা।
পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত ভিডিওগুলিতে লতিফা তাদের ইয়ট আক্রমণের বিশদ বিবরণী দেন।
"আমি লড়াই করেছিলাম, একজন লোক একটি সুঁই বের করে আমাকে হাতে ইনজেকশন দেয়।"
তারপরে তাকে ভারতীয় সামরিক জাহাজে স্থানান্তর করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন লতিফা।
"কমান্ডোরা আমাকে করিডোর দিয়ে একটি বড় ঘরে নিয়ে গিয়েছিল, আমার সামনে সম্ভবত চার বা পাঁচ জন জেনারেলকে দেখতে পাই আমি,"
"আমি তাদেরকে বেশ কয়েকবার বলেছি 'আমার নাম লতিফা আল মাকতুম',"
"আমি দুবাই যেতে চাই না, আমি আশ্রয় পেতে চাই। আমি আন্তর্জাতিক জলসীমানায় ছিলাম, আপনাদের আমাকে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ।"
তবে তার আবেদনে কর্ণপাত করেনি ভারতীয় সেনারা। একজন কমান্ডোর ব্যাপারে অভিযোগও জানিয়েছেন তিনি।
"সে আমাকে ধরে শুন্যে উঠিয়ে ফেলে । বিশালদেহী হওয়ায় আমি তার সাথে পেরে উঠছিলাম না। তবে আমি দেখতে পাই যে তার জামার হাতা গোটানো ছিল। একটি সুযোগই ছিল পালটা আক্রমণের।"
তারপরই তাকে ট্রাঙ্কুইলাইজার দিয়ে অচেতন করে দুবাই পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
"আমি সেই মুহুর্তে সত্যিই প্রচণ্ড বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। আমি বুঝতে পারলাম স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এত বছর যাবত যতো কাজ করেছি সবই ব্যর্থ এখন। আমি তখন থেকেই এখানে আছি, নির্জন কারাবাসে। এখানে নেই কোনো চিকিৎসা সেবা, কোনও বিচার নেই, অভিযোগ জানানোর উপায় নেই, কিছুই নেই।"
লতিফাকে আটকের পর তার বন্ধু টিনাকে ইয়টের কর্মচারীদের সঙ্গে আটক করে আমিরাতে নিয়ে যাওয়া হয়, দুই সপ্তাহ আটকে রাখা হয়েছিল তাকে।
তারপরই তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে লতিফার গল্প বলতে শুরু করলেন। তিনি 'ফ্রি লতিফা' ক্যাম্পেইন গ্রুপ গঠন করেন এবং লতিফার ঘটনাটি জাতিসংঘে পেশ করেন।
কিন্তু মাস কেটে গেলেও লতিফার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না তিনি।
তারপর ২০১৯ সালের শুরুর দিকে একদিন তিনি ফিনল্যান্ডে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে একজন অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে একটি বার্তা পেয়েছিলেন।
প্রথমে তাকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল। বছরখানেক আগে লতিফাকে ব্রাজিলিয়ান মার্শাল আর্ট ক্যাপোইরা শিখিয়েছিলেন টিনা। সেই অপরিচিত আগন্তুক টিনার কাছে লতিফার ক্যাপোইরার ডাক নাম জানতে চেয়েছিলেন। তারপরই টিনা সরাসরি রাজকন্যার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন।
"যখন আমি প্রথম তার কন্ঠ শুনলাম, আমি কাঁদছিলাম। আমি কিছুতেই নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।"
লতিফা ভিডিও বার্তা রেকর্ডিং শুরু করেন। ভিডিও বার্তাগুলোতে বিস্ময়কর কিছু তথ্য উঠে আসে।
৩৫ বছর বয়সী রাজকন্যা তার স্নানঘরের কোণায় বসে ফিসফিস করে কথা বলছেন।
"আমি এই ভিডিওটি বাথরুম থেকে করছি, কারণ কেবলমাত্র এটি একমাত্র কক্ষ যে কক্ষের দরজা বন্ধ করার অনুমতি আছে আমার। আমি এখানে জিম্মি। আমি মুক্ত নই, আমি এই কারাগারে বন্দী। আমার জীবনের নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই।"
বলা যায় সূর্যের আলো ছাড়াই তিন বছর অতিবাহিত করেছেন তিনি, মুখাবয়ব ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
"আমি একটি ভিলায় আছি, এবং এই ভিলাটিকে জেলে রূপান্তর করা হয়েছে। বাড়িটির সমস্ত জানালা বন্ধ থাকে। বাইরে পাঁচজন পুলিশ সদস্য এবং বাড়ির ভিতরে দু'জন নারী পুলিশ সদস্য রয়েছেন। মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাহিরেও যেতে পারছি না আমি।"
বিলাসবহুল এলাকায় সমুদ্র উপকূল থেকে কয়েক মিটার দূরেই অবস্থিত এই ভিলা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেন রোথ বলেন, "এটি একটি ভিলা দেখেই সবকিছু ঠিকঠাক এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই,"
"তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এটি মূলত কারাগার বিহীন বন্দিদশা। এধরনের নির্জন বন্দিদশাকে নির্যাতন হিসাবেই বিবেচনা করা হয়। লতিফার ভিডিওগুলিতে তার ভয়টা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।" বলেন কেন রোথ।
"প্রতিদিনই আমি নিজের নিরাপত্তা ও জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি। আমি সত্যিই জানি না আমি এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারব কিনা। আমি আমার পুরো জীবন কারাগারেই কাটাবো এবং আর কখনও সূর্যের আলোর দেখা পাবো না এমন হুমকিও দিয়েছে আমাকে পুলিশ । আমি এখানে নিরাপদ নই," ভিডিও বার্তায় বলছিলেন লতিফা।
তবে গোপন ফোন নিয়ে ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি শান্ত ও পদ্ধতিগতভাবে তার গল্প নথিভুক্ত করা শুরু করেছিলেন।
"ব্যাপারটি আমার জন্য এরকম, আমি কি মুক্ত নাকি মুক্ত নই? ঠিক আছে, আমি যে মুক্ত নই তা পুরো পৃথিবী জানবে। আমার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন যে কেউ জানতে পারবেন আমি মুক্ত নই৷ আমি তাদের প্রচারণার সাথে তাল মিলয়ে চলবো না। আমি এরকমই। "
লতিফার বাবা, শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ জানিয়েছিলেন, তিনি লতিফার দুবাই প্রত্যাবর্তনকে উদ্ধার অভিযান হিসেবেই গণ্য করছেন।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে, লতিফা যখ নয় মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত চাপের মুখে পড়েছিল। জাতিসংঘ লতিফার জীবিত থাকার প্রমাণ পেশের অনুরোধ জানায়। অন্যথায় লতিফা মারা গেছেন এমন উদ্বেগকে সত্য ধরে নিয়ে সামনে এগুনোর কথা জানানো হয়।
লতিফা সৎ মা প্রিন্সেস হায়া দেখা করেন তার সাথে। একটি ভিডিওতে লতিফা বলেছেন, "তিনি আমাকে বলেছিলেন এটি একটি পরীক্ষার মতো হবে। এতো দিন কারাগারে থাকার পর মানুষের আশেপাশে আমি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাই তা দেখা হবে,"
"এবং তুমি যদি ভাল ভাবে আচরণ করো, তোমাকে কিছু দিনের মধ্যেই বাইরে যেতে দেওয়া হবে,"
লতিফার অজান্তেই তার সৎ মা হায়া আরও মিথ্যা বলেছিলেন। লতিফার 'বাইপোলার ডিজঅর্ডার' আছে বলে জানানো হয়। লতিফার বর্তমান অবস্থা ঠিকঠাক তা জাতিসংঘের কাছে প্রমাণ করার জন্য হায়া তার এক বন্ধুকে ডেকেছিলেন। তিনি হলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক হাই কমিশনার মেরি রবিনসন।
তবে এদিকে এব্যাপারে অন্ধকারেই ছিলেন লতিফা। রবিনসনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের সময় তারা শুধু পরিবেশ, স্কাইডাইভিং এবং মেরি রবিনসনের আসন্ন বই নিয়েই আলোচনা করেছিলেন।
লতিফা বলেছিলেন, "সেদিন আমাকে নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি,"
তার কোনও ধারণা ছিল না যে রবিনসন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক হাই কমিশনার।
মেরি রবিনসন জানিয়েছেন তিনি লতিফাকে ভিডিও বা তার পালানোর বিষয়ে প্রশ্ন করেননি বা তার সাথে দেখা করতেও বলেননি।
"কীভাবে বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত কারো সাথে কথা বলতে হয় আমি জানি না। আমি আসলে তার সাথে কথা বলতে চাই নি এবং একটি সুন্দর মধ্যাহ্নভোজনের মধ্যে তার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলে তার মানসিক আঘাত বাড়াতে চাইনি।" বলেন রবিনসন।
তার কয়দিন পরই সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রবিনসনের সাথে লতিফার ছবি প্রকাশ করে দাবি করে রাজকুমারী সুস্থ এবং নিরাপদে রয়েছেন।
সেই মধ্যাহ্নভোজের পরই লতিফাকে আবারও তার সেই ভিলায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। নিখোঁজ রাজকন্যা আগের বন্দিদশাতেই ফিরে যান।
তবে তার সৎ মা প্রিন্সেস হায়ার জীবনে বড়সড় পরিবর্তন আসে। দুই সন্তান নিয়ে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে আসেন তিনি।
হায়া পরে বলেছিলেন লতিফার প্রতি তার আগ্রহে রুদ্ধ হন শেখ, দিন দিন তার প্রতি বৈরী হয়ে ওঠেন। স্ত্রী এবং আরও দুই সন্তানের পালিয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাজ্যে আইনি লড়াইয়ের মুখে পড়েন শেখ।
২০২০ সালের মার্চ মাসে হাইকোর্টের একটি রায়ে তার প্রাপ্তবয়স্ক কন্যাদের সাথে তার আচরণ সম্পর্কে আরও বিশদ বিবরণী প্রকাশ করা হয়।
আঠারো বছর আগে তার আরেক কন্যা শামসাকে যুক্তরাজ্য থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। সেখান থেকে তাকে দুবাইতে নিয়ে যাওয়া হয়, এখন পর্যন্ত সেখানেই বন্দী আছেন তিনি। এই রায়টিতে প্রথমবারের মতো শেখের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত প্রকাশিত হয়। কীভাবে শামসাকে কেমব্রিজ পর্যন্ত ট্র্যাক করে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় এসব তথ্য প্রকাশিত হয়।
প্রিন্সেস হায়াকে ভয় দেখানো হয়েছিল এবং প্রিন্সেস লতিফাকে অপহরণ করে কারাবন্দী করা হয়েছে এই রায় দেন বিচারক।
এই রায়ের পর লতিফার বন্ধুরা আবারও আশায় বুক বাঁধেন, তবে রাজকন্যার বন্দীদশা থেকে মুক্তি মেলেনি এখনো। তিন বছর ধরে একাকী বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন তিনি।
হঠাৎ করেই যেভাবে লতিফার সঙ্গে তার বন্ধুদের যোগাযোগ হয়, তেমনি হঠাৎ করেই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কয়েক মাস যোগাযোগ করতে না পেরে তার বন্ধু টিনা, ডেভিড ও মার্কাস তার ভিডিও বার্তাগুলো প্রকাশ্যে আনার সিদ্ধান্ত নেন।
"আমার মনে হয়েছিল কিছু করার সময় এসেছে। আমরা তার জন্য লড়াই করে যাই, হাল না ছাড়ি এমনটাই চাইবে লতিফা,"
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দুবাই সরকার জানিয়েছে লতিফা তার পরিবারের ভালোবাসায় নিরাপদেই আছেন।
তবে লতিফাকে নিয়ে প্রচন্ড ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন তার বন্ধুরা।
"তার বর্তমান অবস্থা নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত আমরা। গোপন ফোন সহ লতিফা ধরা পড়েছে এমনটাই হয়ে থাকলে, তার বর্তমান অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে।" বলেন টিনা।
- সূত্র: বিবিসি