ব্রিটিশ রাজপরিবারের অর্থের উৎস কী?
"আমি শুধু নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম", অর্থের পেছনে ছুটছেন- এমন অভিযোগের জবাবে উপস্থাপক অপরাহ উইনফ্রেকে এটি বলেন প্রিন্স হ্যারি।
রাজপরিবারের অভ্যন্তরে বর্ণবাদ থেকে শুরু করে আরও অনেক অপ্রিয় সত্যই সেদিন আলোচনার তুঙ্গে থাকা এ সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেন সাসেক্সের ডিউক এবং ডাচেস হ্যারি ও মেগান।
উভয়েই জানান, রাজপরিবার থেকে আলাদা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে আসার পর ভিডিও প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স ও অডিও-স্ট্রিমিং সার্ভিস স্পটিফাইয়ের সঙ্গে তাদের কিছু আর্থিক চুক্তি হয়েছে। এসব চুক্তি থেকেই বর্তমানে সিংহভাগ আয়ের সংস্থান হচ্ছে তাদের।
'বিস্ফোরক' সে সাক্ষাৎকারের ফলে গণমাধ্যমের আলোচনায় ফের উঠে এসেছে ব্রিটিশ রাজপরিবারও। 'ব্রিটিশ সূর্য কখনো অস্ত যায় না' -একসময়ের সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ না থাকলেও, এখনও ব্রিটিশ রাজের সম্পদের পরিমাণ গুনতে বসলে নতুন করে এ প্রবাদটিই মনে পড়বে!
ব্রিটিশ রাজপরিবারের সবচেয়ে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির পাশাপাশি সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিও রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ । গত বছর ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম দ্য টাইমস প্রকাশ করেছিল, ব্রিটেনের রানীর ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড (৪৮৬ মিলিয়ন ডলার প্রায়) এবং রাজপরিবারের মোট সম্পদ এই অর্থের বহুগুণ বেশি।
কিন্তু ব্রিটিশ রাজপরিবারের এই অঢেল সম্পদের উৎস কী?
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে এখনো রয়েছে বেশ কিছু জমি ও এলাকা। একত্রে এদের 'ক্রাউন এস্টেট' হিসেবে অভিহিত করা হয়। ক্রাউন এস্টেটের আওতাভুক্ত হলো ইংল্যান্ডের অ্যাসকোট রেসকোর্স, মধ্য লন্ডনের একটি বড় অংশ ও উপকূলবর্তী অর্ধেক অংশ, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড। ক্রাউন এস্টেটটি স্বায়ত্তশাসিতভাবে পরিচালিত হয়- এবং এর লভ্যাংশের (গত বছর ৩৪৫ মিলিয়ন পাউন্ড) পুরোটাই যায় ব্রিটিশ সরকারের কোষাগারে।
তবে এই অর্থের কিছু অংশ আবার রাজপরিবারে 'সিভিল লিস্ট' হিসেবে ফেরত দেওয়া হয়।
২০১১ সালে এই ফিরতি অর্থের পরিমাণই ছিল প্রায় ১৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন পাউন্ডের কাছাকাছি, রাজকর্মচারীদের বেতনে যার অধিকাংশ ব্যয় হয়।
তাছাড়া ব্রিটিশ রাজপরিবার সরকারের কাছ থেকে বাৎসরিক হারে 'গ্র্যান্টস ইন এইড' নামক একটি অনুদান পেত যার অর্থ ব্যয় হতো রাজ সদস্যদের ভ্রমণ, যাতায়াত এবং প্রাসাদের সংস্কারের জন্য ।
২০১১ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৪ মিলিয়ন পাউন্ড ( ভ্রমণে ৬ মিলিয়ন, প্রাসাদের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে ১১.৯ মিলিয়ন পাউন্ড এবং যাতায়াতের জন্য ৫ লাখ পাউন্ড )। ২০১২ সালে এই সব খাতকে 'সোভেরেইন গ্র্যান্ট' নামক একটি মাত্র অনুদানের আওতায় নিয়ে আসা হয়।
শতবর্ষী বাকিংহাম প্যালেসের জৌলুশ ফিরিয়ে আনতে নেয়া সংস্কার কার্যক্রমের জন্য ২০১৬ সালে সোভেরেইন গ্র্যান্টের এই খরচ বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
বর্তমানে ক্রাউন এস্টেটের বার্ষিক মুনাফার ২৫% হিসেবে এই সোভেরেইন গ্র্যান্ট এর অর্থ নির্ধারিত হয়। অবশ্য ২০২৭ সালে একে ১৫% এ নামিয়ে আনার কথা রয়েছে। গত বছর এই অনুদানের আওতায় ৮.২৪ মিলিয়ন পাউন্ড পরিশোধ করা হয়।
রাজপরিবারের আয়ের আরও দুটি বড় উৎস হলো 'ডুচি অব ল্যাংকেস্টার' এবং 'ডুচি অব কর্নওয়াল' নামক প্রাইভেট এস্টেট। রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারস্বরূপ প্রথমটি রানী এবং দ্বিতীয়টি প্রিন্স চার্লসের মালিকানাধীন। এই দুটি প্রাইভেট এস্টেট জমি, সম্পদ এবং আর্থিক সম্পত্তি নিয়ে গঠিত। ২০১৭ সালে ডুচি অব ল্যাংকেস্টার কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের তহবিলে কয়েক মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে বলে শোনা যায়। এর বাইরে ডুচি অরিজিন্যালস, নামে প্রিন্স চার্লসের একটি কোম্পানি রয়েছে যা দামি বিস্কুট এবং 'প্রাকৃতিক খাবার' তৈরী করে থাকে। এ থেকে যত লাভ হয়, তার পুরোটা যায় দাতব্যের কাজে।
গত বছর ডুচিদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১.৬ বিলিয়ন পাউন্ডে; বার্ষিক মুনাফা লাভ হয় ৪৭ মিলিয়ন পাউন্ড। এই অর্থের পুরোটাই রয়্যালরা তাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় করে থাকে। যদিও প্রিন্স চার্লস বরাবরই বলে আসছেন, এখান থেকে তিনি অনুদানে অর্থ ব্যয় করেন এবং নিয়মিত আয়কর দেন।
বাকিংহাম প্যালেসের বাইরেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অন্যান্য প্রাসাদগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেসব সদস্যরা বাস করেন, তা রাষ্ট্রের আওতাধীন। ফলে তারা সেসব কখনোই বিক্রি করতে পারবেন না।
তবে আলাদাভাবে রাজপরিবারের প্রত্যেক সদস্যই ব্যক্তিগত সম্পদের মালিকানা ধরে রেখেছেন। যেমন- রানী একাই স্কটল্যান্ডের বালমোরাল ক্যাসল এবং নোরফোকের সানদ্রিংহাম এস্টেটের অধিকারী। এই দুটি সম্পত্তি তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে তার পিতা ষষ্ঠ জর্জের কাছ থেকে পেয়েছেন ।
হ্যারি এবং মেগানের জন্যও সোভেরেইন গ্রান্টের আওতায় অর্থ বরাদ্দ ছিল। যদিও প্রিন্স হ্যারি অপরাহ উইনফ্রের শোতে এসে জানিয়েছেন, রাজপরিবার তাকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে।
জানা গেছে, প্রিন্স চার্লসের অ্যাকাউন্ট থেকে ক্যামব্রিজের ডিউক ও ডাচেসসহ এই জুটির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পেছনে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় হয়েছে। তাছাড়া প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি- দুই ভাই তাদের প্রয়াত মা প্রিন্সেস ডায়ানার রেখে যাওয়া ১৩ মিলিয়ন পাউন্ড সমমূল্যের সম্পদের ভাগ পেয়েছেন। অপরাহকে হ্যারি নিজেই জানান, মায়ের রেখে যাওয়া সম্পদ না থাকলে তাদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে আসার মত এত বড় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হতো না।
কোভিড-১৯ মহামারীর আগে এক নজর বাকিংহাম প্রাসাদ দেখতে ভিড় জমাত পর্যটকের দল। ফলে ব্রিটেনের কোষাগারে পর্যটন থেকেও তখন আয় হতো।
প্রিন্স চার্লসের মতোই রানীও নিয়মিত কর পরিশোধ করেন। ইনকাম ট্যাক্সের সাথে বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বাকিংহাম প্যালেসের জন্য তিনি কাউন্সিল ট্যাক্স প্রদান করে থাকেন।
পরিশেষে এটাই বলা যায়, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ও ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ এবং ব্রিটিশ সরকারের অনুদান- এ দু'য়ে মিলেই ব্রিটিশ রাজপরিবারের সম্পদের আপাত ব্যাখ্যা স্পষ্ট হয়।
রাজপরিবার ছেড়ে যাওয়ায় এবং অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের স্বাবলম্বী হবার প্রচেষ্টায় হ্যারি এবং মেগানকে এখন থেকে আর রাজপ্রাসাদের অনুদানের ফর্দ, সম্পদ, ট্যাক্স আর নানান নিয়মতান্ত্রিকতার খোলসে জড়াতে হবে না। অঢেল সম্পদ আর রাজকীয় নিরাপত্তা নিজ পায়ে ঠেলে দিয়ে, সামনে তাদের মূল্য চুকোতে হয় কিনা সেটি সময়ই বলবে।
- দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে