ভারত বনাম ফেসবুক, টুইটার: ঘনিয়ে উঠছে প্রযুক্তির বিশাল লড়াই
অনলাইনে নিজ নাগরিকদের মুক্ত আলোচনা নিয়ন্ত্রণে দিন দিন কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসংক্রান্ত চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে এখন ফেসবুক ও টুইটারের মতো বহুল ব্যবহৃত সামাজিক প্ল্যাটফর্মকে।
সামাজিক মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে এ চেষ্টা এমন উদাহরণ সৃষ্টির ঝুঁকিও তৈরি করছে, যার প্রভাব ভারতের নিজ সীমানার বাইরে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পড়বে। তাছাড়া, এটি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক নীতিকেও প্রভাবিত করবে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত প্রাইভেসি ও বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপে অন্তর্বর্তীকালীন বিধিমালা জারি করে নরেদ্র মোদির সরকার। এসব কড়াকড়ির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত দুই টেক জায়ান্টকে লড়তে হচ্ছে।
তার ওপর, মহামারির কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়, স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দায়ী করে পোস্ট করেন অনেক ভারতীয়।
এমন শত শত পোস্ট সরিয়ে ফেলতে নতুন বিধিমালা অনুসারে ফেসবুক ও টুইটারকে নির্দেশ দেয় ভারত সরকার; যা না মানলে কোম্পানিগুলোর আঞ্চলিক নির্বাহীদের জেল-জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে।
ভারতের বর্তমান প্রশাসন ব্যবহারকারীর তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে যেভাবে চাপ দিচ্ছে- তা বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণে ক্রমবর্ধমান প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ। জনমত প্রকাশে প্রযুক্তি জায়ান্টদের ব্যাপক ক্ষমতা অনুধাবন করেই চলছে এ দমননীতি।
তবে চীনের বিশাল বাজারে মার্কিন সামাজিক মাধ্যমের প্রবেশাধিকার না থাকায়, ভারতের বাজার ও সেখানে ভোক্তা আস্থা ধরে রাখাও বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শত কোটির বেশি ব্যবহারকারীর এ বাজার হারানো তাদের অপূরণীয় আর্থিক লোকসানের পাশপাশি; প্রযুক্তিযুদ্ধে চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের জয়-পরাজয় নির্ধারণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
এভাবে ভোক্তা আস্থা নিশ্চিত করার সাথে সাথে সরকারি চাপ মোকাবিলা ও স্থানীয় আইন মেনে চলা হয়ে উঠেছে এক দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আরোপিত বিধিনিষেধ অন্যান্য স্বেচ্ছাচারী সরকারের সামনে এক নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। ফলে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে খর্ব হবে নেটিজেনদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
ডিজিটাল প্রাইভেসি রক্ষায় কাজ করা দ্য ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন গত এপ্রিলে জানায়, "ভারত সরকার নিজস্ব নীতিতে দমনমূলক পরিবর্তন যুক্ত করেছে। এতে নাগরিকদের ওপর নজরদারিতে কর্তৃপক্ষের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হলো। এসব নীতিমালা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের অন্যতম ভিত্তি- মুক্ত ও অবাধ ইন্টারনেট বিচরণের পরিপন্থী।"
সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে পর্যবেক্ষণে রাখার তাগিদ যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশেও দেখা যাচ্ছে। তবে এসব দেশের সরকার বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত; বর্ণবিদ্বেষ ও অপপ্রচার বন্ধে চাপ দিলেও- ভারতে সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ণকারী পোস্ট প্রকাশের জন্য কোম্পানিগুলোকে দায়ী করার বিধান রাখা হয়েছে।
এ বাস্তবতায় কোটি কোটি ব্যবহারকারীর স্বার্থ সুরক্ষায় সাম্প্রতিক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে ভারতের আদালতে আইনি চ্যালেঞ্জ করেছে ফেসবুকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হোয়াটসঅ্যাপ।
হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, সরকারের নতুন বিধিমালা তাদের তথ্য গোপনীয়তা পদ্ধতির পরিপন্থী। এই সুরক্ষার নিশ্চয়তায় ব্যবহারকারীদের কাছে তাদের আস্থার প্রতীক এবং বৈশ্বিক বাজারজাতকরণের মূল আকর্ষণ। অর্থাৎ, ইনক্রিপশন পদ্ধতিটি ভঙ্গ হলে তাদের বাণিজ্যিক সুবিধাটিও হারিয়ে যাবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত মাইক্রো ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম টুইটারকে নিয়ন্ত্রণ করতে গত কয়েক মাস ধরেই তৎপর মোদি প্রশাসন। অথচ মাধ্যমটি ভারতের অনেক সেলিব্রেটি ও প্রভাবশালী রাজনীতিকরা ব্যবহার করেন। অনেক ঘটনার নিজস্ব ব্যাখ্যা ও পর্যবেক্ষণ টুইটের সাহায্যে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরেন তারা। এই বিষয়টিই ভারতের ক্ষমতাসীনদের পছন্দ হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদের প্রভাবশালী অনেক সদস্য মার্কিন কোম্পানিটির বিরুদ্ধে নতুন ডিজিটাল বিধিমালা অমান্য করার অভিযোগ তুলে বলেছেন- মাধ্যম হিসেবে টুইটারের 'স্ট্যাটাস' বাতিল করে তার পরিবর্তে কোম্পানিটিকে সরকারি পোস্টকৃত কন্টেন্ট –এর জন্য দায়ী করা উচিত।
এই রেষারেষি নতুন মাত্রা পায় গত মে'তে- তখন মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির করা বেশকিছু পোস্টে 'ভুয়া তথ্যের' লেভেল সেঁটে দেয় টুইটার।
ওই ঘটনার পর কোম্পানিটির ভারতীয় শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী ও কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ, পরিদর্শন করেছে কোম্পানির কার্যালয়। এভাবেই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনসংখ্যার দেশে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবসা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
কোম্পানিটির সংকট তুলে ধরে প্রযুক্তি নীতি বিষয়ক ব্লগ- টেকডার্টের প্রতিষ্ঠাতা মাইক ম্যাসনিক বলেন, "টুইটার এখন চরম অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। যেদিকেই যাক, এভাবে তারা জিততে পারবে না। যেমন; সরকারের কথা শুনে তারা যদি ব্যবহারকারীদের সেন্সর করে তাহলে বাক-স্বাধীনতা খর্ব হবে, ভোক্তাদের আস্থাও কমবে। আর একবার চাপের কাছে নতি-স্বীকার করলে সমালোচকদের কন্টেন্ট বন্ধে আরও বেশি চাপ দেওয়া হবে।"
একথার মাধ্যমে টুইটারকেও যে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং তাতে জিতেই ভারতে ব্যবসা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে তার ইঙ্গিত দিলেন তিনি।
এব্যাপারে ব্রিটিশ গণমাধ্যম- দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের পক্ষ থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিক্স ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলেও কর্তৃপক্ষটি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করে।
তবে ভারতে সকলকেই সরকারের পূর্ব ঘোষিত নীতিমালা মেনে চলতে হবে বলে জানানো হয়।
- সূত্র: দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডটইউকে