মহামারির অভিঘাতে নেপালের ট্রেকিং শিল্প কি ধ্বংসের মুখে?
ভারতে প্রাপ্ত কোভিড-১৯ ভাইরাসের বি.১.৬১৭.২ প্রকরণের প্রাদুর্ভাবে গত এক মাসে নেপালে করোনার নতুন ঢেউ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রাথমিক প্রমাণাদি অনুসারে নতুন এই প্রকরণকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া সবথেকে বেশি সংক্রমণযোগ্য প্রকরণ বলে ধরা হচ্ছে।
নেপালের হাসপাতালগুলো রোগীদের ধারণক্ষমতার মাত্রা অতিক্রম করেছে। হাজারো মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। অন্যদিকে, এভারেস্টের বেজ ক্যাম্পেও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে সংক্রমণ।
তবে, নতুন ঢেউয়ের আগে থেকেই নেপাল মহামারির কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। ভাইরাসের তুলনায় এই আর্থিক বিপর্যয় নিয়েই এভারেস্টের সলুখুম্বু অঞ্চলের শেরপারা বেশি চিন্তিত।
নেই ট্রেকিংয়ে আসা পর্যটক
সরকারের আরোপিত লকডাউন এবং পর্যটকদের দ্বিধার কারণে ২০২১ সালের প্রথম পাঁচ মাসে হুট করেই কমে গেছে সাগারমাথা ন্যাশনাল পার্কের দর্শনার্থীদের সংখ্যা।
নেপাল সরকার চলতি বছর রেকর্ড সংখ্যক ৪০৮ জন বহিরাগতকে পর্বতারোহণের অনুমতি প্রদান করেছে। বসন্ত মৌসুমে এভারেস্টে পর্বতারোহীরা ফিরে আসলেও ট্রেকিং করতে আসা ভ্রমণার্থীদের দেখা মিলেছে খুব কম। ৯৯ শতাংশের বেশি ভ্রমণার্থী ট্রেকিংয়ের উদ্দেশ্যে আসেন।
অভিযানের উদ্দেশ্যে বহু মানুষ আসলেও স্থানীয় লজগুলোকে টিকে থাকতে মূলত ট্রেকিং করতে আসা ভ্রমণার্থীদের ওপর নির্ভর করতে হয়ে বলে মন্তব্য করেন বেজ ক্যাম্পের নিকটবর্তী হিমালয়ান লজের মালিক পাসাং শেরিং শেরপা।
২০১৫ সালে এক ভূমিকম্পে এখানকার বহু গ্রামের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। তবে, স্থানীয় অনেকেই বলছেন যে, এবারের মহামারির ডেকে আনা অর্থনৈতিক বিপর্যয় ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের থেকেও বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে।
"ভূমিকম্পের সময় অধিকাংশ বাড়ি ধসে পড়েছিল, কিন্তু, সেগুলো পুনঃনির্মাণের পর অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মহামারির পর...কিছুই নেই," বলেন গাইড এবং লজ মালিক শেরিং ওয়ানচু শেরপা।
ধসের মুখে স্থানীয় পর্যটন শিল্প
বসন্তের মৌসুম শেষ হয়ে আসায় স্থানীয়দের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহের জন্য বিকল্প আয়ের সন্ধান করতে হবে। কিন্তু, বর্ষা শুরু হলেও অধিকাংশ মানুষই এখনও জানেন না যে তারা কী করবেন।
"প্রথম তিন বা ছয় মাস চালানো গেছে। কিন্তু, এক বছর পর এটা এক সমস্যা। আগে আমরা কিছুটা অর্থ সঞ্চয় রেখেছিলাম। কিন্তু, তা ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে," বলেন লজ মালিক লোপসাং শেরপা।
লোপসাং ২০১৩ সালে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে চুখুং গ্রামে দ্বিতল লজ গড়ে তুলেন। গ্রামের মানুষ একসময় ইয়াক বা চমরী গাই চড়ানোর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত।
১৯৮২ সালে লোপসাংয়ের জন্মের সময় খুম্বুতে প্রতি বছর মাত্র পাঁচ হাজারের মতো পর্যটক আসতেন। ২০০০ সালে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজার। ইয়াক পালন ছেড়ে লোপসংয়ের বাবা-মা একটি চায়ের দোকান এবং ডর্ম খুলেন। ২০১৩ সালে লোন নিয়ে তিনি খাংরি রিসোর্ট লজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট চালু করেন করেন। দুই তলা লজটিতে, ব্যক্তিগত ঘর, পশ্চিমা খাবার এবং ওয়াই-ফাইয়ের ব্যবস্থা আছে। ২০১৮ সালে পর্যটক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮ হাজার।
"লজের পেছনে সবাই মোটা বিনিয়োগ করে," বলেন লোপসাং। স্থানীয়রা বিগত দশকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পৈতৃক চারণভূমিতে লজ নির্মাণ বা পর্যটক কেন্দ্রিক অন্যান্য ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কিন্তু এই ব্যবসায় পা রাখা খুব একটা সহজ নয়। এভারেস্ট অঞ্চলের এই গ্রামগুলো থেকে পায়ে হেঁটে নিকটস্থ রাস্তায় পৌঁছাতে কয়েকদিন সময় লেগে যায়। নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি নিয়ে আসতে কুলি, মালবাহী পশু বা হেলিকপ্টারের প্রয়োজন পড়ে। কাঠমাণ্ডু থেকে এখানে আকাশপথে এক টন সরঞ্জামাদি আনতে প্রায় তিন হাজার ডলার খরচ পড়ে। নেপালের অধিকাংশ মানুষের সারাবছরের উপার্জনের চেয়েও এই অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি।
পর্বতের ওপর ১৫ ঘরের একটি ছোট লজ নির্মাণ করতে শেরিং তেনজিংয়ের প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ পড়েছে। এর পুরোটাই তেনজিং ঋণ আকারে নেয়।
কিন্তু, সুদের হার এখন অনেক উচ্চ বলে হতাশা প্রকাশ করেন লোপসাং।
"যদি এরকম চলতে থাকে তাহলে আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে," বলেন তেনজিং।
বন্ধ হয়ে গেছে উপার্জন
পর্যটক না থাকায় পশুপালকরাও কঠিন সময়ের সম্মুখীন হচ্ছে। গাধা, ইয়াক এবং ইয়াক ও গরুর সংকর জোয়াসের মাধ্যমে পশুপালকরা যাত্রীদের মালামাল পরিবহনে সাহায্য করে থাকে। মহামারি শুরু হওয়ার পর যাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ার পরিবহন খরচও অর্ধেকে নেমে এসেছে।
ফলে, পালিত পশুদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের যোগান দিতেও হিমিশিম খাচ্ছেন স্থানীয় পশুপালকরা।
ভালো নেই ভ্রমণার্থীদের সাহায্যকারী গাইডরাও।
২৩ বছর বয়সী রিটা দর্জি শেরপা এভারেস্ট ও জাপানে বিভিন্ন ভ্রমণে গাইডের কাজ করতেন। কিন্তু, মহামারির কারণে পর্যটক সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে কোনো উপার্জন নেই চার সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী এই গাইডের।
"পর্যটক নেই, ভিসা নেই, তাই কাজও নেই," বলেন তিনি।
জলবায়ু বিপর্যয়ে কমে গেছে ফলন
এভারেস্ট অঞ্চলের প্রধান খাদ্য আলু। শীত আসার আগে বছরে একবার এখানে আলুর চাষ হয়। গত বছর অন্যান্য সময়ের থেকে ফলন ৪০ শতাংশ কমে যায়। স্থানীয়দের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্র ও ভারি বৃষ্টিপাতে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়।
আগামী শীত আসার আগে পর্যটন অবস্থার উন্নতি না হলে এবং ফলন পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবারের সদস্যদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সংস্থান করা সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
পর্যটকদের অনুপস্থিতিতে মানুষ তাদের পুরনো পশু চারণ বা কৃষিকাজের পেশাতে ফিরে যাবেন বলেও মনে করছেন অনেকেই।
তবে, স্থানীয়রা এখনো বিষয়টির জন্য প্রস্তুত নয় বলেও আশঙ্কা অনেকের।
লোপসাং বলেন, "করোনা ভাইরাস যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে আমরা ২৫ বছর পিছিয়ে যাব,"। "বিষয়টি বেশ কঠিন হবে, কেননা আমাদের পুরনো অভ্যাসগুলো ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে," বলেন তিনি।
পর্যটন ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার নিয়ে আশা
তবে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগের আকর্ষণে পর্যটকরা ফিরে আসবে বলেও আশা রাখছেন অনেকে।
স্লোভাকিয়ান ট্রেকিং পর্যটক অন্দ্রেজ জেনিক বলেন, "প্রথম যখন পর্বতগুলো দেখি, আমি পুরো থমকে যাই।"
"এখানে আসতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি," বলেন জি আর রাধিকা। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের প্রথম নারী হিসেবে সাত মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের চেষ্টা করছেন তিনি।
"এখন আমরা শেরপাদের সাথে গল্প করার সুযোগ পাই। শেরপাদের গল্পগুলো এক কথায় অসাধারণ," বলেন চেক অভিযাত্রী জান সিমার্ক।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ভ্রমণপিপাসুদের আগমনে আবারও পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গের এই অঞ্চল মুখরিত হবে বলেই আশা স্থানীয়দের। বৌদ্ধ লামাদের কাছ থেকে জ্ঞানের সন্ধান ও স্থানীয়দের কাছে সংস্কৃতি বিষয়ক জ্ঞান আহরণে কিংবা, স্নো লেপার্ড বা তুষার চিতার পদচিহ্ন অনুসরণ করতে আবারও হয়তো মানুষ দুর্গম এই অঞ্চলে পাড়ি জমাবে।
কিন্তু ততদিন পর্যন্ত, সলুখুম্বুর শেরপাদের টিকে থাকতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।