মহামারি চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ: ডেক্সামেথাসন কীভাবে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় কার্যকর
পৃথিবীর প্রাণচঞ্চলতা কেড়ে নিতে বদ্ধপরিকর যেন নতুন করোনাভাইরাসের মহামারি। এর নির্মম নখরে প্রতিদিনই ঝড়ে পড়ছে অজস্র জীবন, স্থবির হয়ে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। তাই ঘাতক কোভিডের গতি থামাতে দ্রুত স্থায়ী প্রতিষেধক তৈরির গবেষণা চলছে বিশ্বব্যাপী।
এ ধরনের একটি ভ্যাকসিন তৈরিতে ১৮ মাস সময় লেগে যেতে পারে। তাই প্রচলিত কিছু ওষুধকে এখন চিকিৎসা কাজে লাগানো যায় কি না, সেই সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর ফলে বিদ্যমান ওষুধের ব্যবহার প্রাণ বাঁচাতে সহায়ক হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের ১৪ শতাংশকে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। সংক্রমণের বৈশ্বিক ব্যাপকতা বিচারে প্রচলিত ওষুধ ব্যবহার করে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করা যে এখন মারাত্মক জরুরি হয়ে উঠেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
গত মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা 'সলিডারিটি' বা সম্প্রীতি নামে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ওষুধের ব্যবহার পরীক্ষার এক কর্মসূচী নেয়। এর আওতায় বিদ্যমান নানা জীবাণুনাশক ওষুধ কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করতে পারে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে কখনোই এত বড় আকারের ওষুধ পরীক্ষার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।
নানা ওষুধের কার্যকারিতা নিরীক্ষার এই কর্মসূচির আওতায় বেশ কয়েকটি দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং শত শত হাসপাতালে ভর্তি হাজার হাজার আক্রান্ত রোগীর ওপর প্রয়োগ করা বিভিন্ন প্রচলিত ওষুধের প্রভাবজনিত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এই উদ্যোগের পেছনে মূল ভাবনা ছিল যে, নতুন করে একটি ওষুধ তৈরি করতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যায়, সেই তুলনায় প্রচলিত ওষুধ যেগুলো অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়, তা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সফল হয় কিনা, তা খুঁজে বের করা।
একারণে বিজ্ঞানীরা বিশেষ বিশেষ কিছু ওষুধের কার্যকারিতা যাচাই করে দেখেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো; লোপিনাভির- রিটোনাভির, যা কালেট্রা নামেও পরিচিত। এইচআইভি রোগাক্রান্ত রোগীর দেহে যখন প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে, তখন এই জীবাণুনাশক ওষুধ ব্যবহার করেন চিকিৎসকরা। পরীক্ষা করা হয়েছে, স্টেরয়েড ডেক্সামেথাসন। এই পরীক্ষায় বেশ কিছু আশাপ্রদ ফল পাওয়া গেছে। আজকের আলোচনার মূল কেন্দ্র এই ওষুধ।
ডেক্সামেথাসন:
কয়েক মাস পূর্বেও করোনার চিকিৎসা নিয়ে যে গভীর হতাশা বিরাজ করছিল তা অনেকটাই কেটেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের সাম্প্রতিক ঘোষণায়।
যুক্তরাজ্যে আক্রান্ত ২ হাজার রোগীকে ডেক্সামেথাসন পরীক্ষামূলকভাবে দেওয়া হয়। এই ওষুধ প্রয়োগের পর রোগী মৃত্যুহার কমে আসার দিক থেকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। প্রাণসংশয়ে থাকা রোগীদের জীবনরক্ষায় এর সফলতার কারণেই এই আবিষ্কার বিশ্বের অন্যান্য দেশের চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের জানানো হয়। ফলে রোগীর জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে তারাও গবেষণাটির সুফল পাবেন।
ডেক্সামেথাসন হচ্ছে একটি স্টেরয়েড জাতীয় উদ্দীপক হরমোন জাতীয় ওষুধ। শিশুদের সর্দি-কাশি, অ্যাজমা, রিউমেটয়েড আর্থারাইটিস ইত্যাদি নানা সাধারণভাবে দেখা দেওয়া স্বাস্থ্য সমস্যার প্রতিকারে অনেক আগে থেকেই এটি সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে।
এই ওষুধের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। তা হলো; এটি রোগীর দেশের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কিছুটা নিষ্ক্রিয় করার মাধ্যমে কাজ করে। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এ জন্যেই ওষুধটি কার্যকর।
ইতোমধ্যেই আমরা জানতে পেরেছি যে, যেসব রোগীর অবস্থা খুব সংকটাপন্ন হয় তার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ তাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অতিরিক্ত তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে এটি ফুসফুসের রোগাক্রান্ত কোষের পাশাপাশি সুস্থ কোষকেও আক্রমণ করে বসে। ফলে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা তীব্র হয়ে ওঠে।
এই অতি-প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডেক্সামেথাসন শরীরের ইম্যিউন সিস্টেমকে শুধু আক্রান্ত কোষকে আক্রমণে বাধ্য করে।
পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখা গেছে, এতে ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে শ্বাস নিতে বাধ্য রোগীদের মৃত্যু হার এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। আর যাদের শুধু অক্সিজেন সরবরাহ দরকার তাদের ক্ষেত্রে কমেছে এক-পঞ্চমাংশ।
দীর্ঘকাল ধরে এই ওষুধটি ব্যবহার হয়ে আসায়, এখনে এর ওপর কোনো কোম্পানির মেধাস্বত্ব অধিকার বা পেটেন্ট নেই। এর ফলে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলো খুব স্বল্প খরচে এই ওষুধ ব্যবহারের সুযোগ পাবে। এ সমস্ত দেশে যখন ভাইরাস বিপর্যয় সৃষ্টি করছে, তখন তার মাঝে কিছুটা ভরসা জোগাবে ওষুধটির ব্যবহার।
এটি অবশ্যই অত্যন্ত ভালো খবর। তবে ভুলে গেলে চলবে না। ডেক্সামেথাসন ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পারে না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কারো এটি কেনা বা সেবন করাও উচিৎ হবে না।
- অনুবাদ: নূর মাজিদ