মোদিকে ছাড় দেওয়া ভারতীয় গণমাধ্যমের বোধোদয় ঘটিয়েছে মহামারি
ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকা পরিস্থিতিতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। শয্যা এবং অক্সিজেনের সরবরাহ সংকট ছাড়াও দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বল্পতা। উপচে পড়া হাসপাতালগুলোর বাইরে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছেন রোগীরা। শ্মশানে একেকটি চিতার কাঠ সাজানোর আগেই জমে উঠছে লাশের স্তূপ। বড় শহরগুলোতে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও দেশের প্রান্তিক জনপদের লড়াই এখনো চলমান।
বিরোধীদলীয় নেতাদের থেকে শুরু করে সরকার সমালোচক, বিচারক, সাধারণ মানুষ এমনকি ল্যানসেটের মতো নামকরা চিকিৎসা সাময়িকী পর্যন্ত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনায় সরব। বিশাল এক মর্মান্তিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও ভারতের নেতারা এখনও দুর্যোগ মোকাবেলার চাইতে ভাবমূর্তি রক্ষা নিয়ে অধিক ব্যস্ত বলে দাবি সমালোচকদের। অন্যদিকে, মোদি প্রশাসনের বক্তব্য অনুযায়ী, সরকার শুধু মিথ্যা ও ভ্রান্ত তথ্য ছড়ানো বন্ধেই সচেষ্ট।
মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকতা:
প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধানে বহু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এখন প্রথাগত সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকেছে। পায়ে হেঁটে মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকতার মাধ্যমে বাস্তবতার অনুসন্ধান করছেন গণমাধ্যম কর্মীরা।
বহু পাঠককেই চমকে দিচ্ছে এমন প্রতিবেদন। সাত বছর আগে প্রথমবারের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ক্রমশ মোদি সরকারের প্রতি অধিকাংশ গণমাধ্যমের আনুগত্য বৃদ্ধি পায়।
ক্ষমতাসীন এই দল বিভিন্ন ধারার কৌশল অবলম্বন করে গণমাধ্যমের বাধ্যতা নিশ্চিত করে। বিজ্ঞাপনদাতাদের সরকারি নীতিমালার সমালোচনা করা গণমাধ্যমগুলোকে বয়কটে বাধ্য করা থেকে শুরু করে, অনেক গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে মোদি সরকার।
গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা নির্ভর অ্যাওয়ার্ড জয়ী স্বাধীন সংবাদ ওয়েবসাইট নিউজলন্ড্রির সিইও অভিনন্দন শেখরি বলেন, "মূলধারার গণমাধ্যম, বিশেষত সম্প্রচার মাধ্যম নিজেদের নিরপেক্ষ উপস্থাপন করলেও, প্রকৃতপক্ষে মোদি সরকারের ব্যর্থতা চাপা দিতে তা হালকাভাবে উপস্থাপন করে।"
"তবে, দৈনিক ভাস্করের মতো পত্রিকাগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখেনি। তারা প্রকৃতঅর্থেই সরকারের পেছনে লেগেছে," বলেন তিনি। এছাড়া, মহামারিকালীন প্রতিবেদনে প্রধান টেলিভিশন চ্যানেলগুলো 'চিরাচরিত সুবিধাবাদী' রূপে থেকে গেছে বলেও মন্তব্য তার।
তারপরও, গুজরাটে মোদির নিজের রাজ্যের স্থানীয় তিন শীর্ষ পত্রিকা সন্দেশ, দিব্য ভাস্কর এবং গুজরাট সমাচার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রতিবেদনগুলোতে বারবার দাপ্তরিক পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
মে মাসের মাঝামাঝি এক প্রতিবেদনে দিব্য ভাস্কর ৭১ দিনে গুজরাটে এক লাখ ২৪ হাজার মৃত্যুসনদ জারির কথা প্রকাশ করে। গত বছর একই সময়ের তুলনায় মৃতের সংখ্যা ৬৬ হাজার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
রাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে কোভিডের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন মাত্র চার হাজার ২১৮ জন। অধিকাংশ মৃত্যুর ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক থাকার পাশাপাশি, রোগীর একাধিক উপসর্গ ছিল বলেও উল্লেখ করে দিব্য ভাস্কর। চিকিৎসক ও ভুক্তভোগীদের পরিবারের বরাতে সংবাদপত্রটি এই বিষয়গুলো উপস্থাপন করে।
পত্রিকাটি আরও জানায়, সাংবাদিকরা জেলা এবং পৌরসভার কাছ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে।
একইভাবে, গুজরাটের শতবর্ষ বয়সী পত্রিকা সন্দেশও দৈনিক মৃতের সংখ্যা অনুসন্ধানে প্রতিবেদকদের সশরীরে মর্গ, হাসপাতাল এবং শ্মশানে পাঠাচ্ছে।
গত ৯ মে, 'গুজরাট সমাচার' পত্রিকায় নতুন সংসদ ভবনের পেছনে মোদির ২.৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় পরিকল্পনার সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। শিরোনামে পত্রিকাটি লিখে, "মানুষ যখন জীবন-মৃত্যুর মাঝে লড়াই করছে, সরকারি কর্মচারীরা তখন স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছে।"
ভারতের গণমাধ্যম স্বত্বাধিকারীরা কি সত্যিই সাহসী হয়ে উঠেছে?
গত কয়েক বছর ধরেই ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যমে জবাবদিহি দাবি করা প্রতিবেদনগুলো এক রকম অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু, দেশজুড়ে কোভিড তাণ্ডবের পর জনসাধারণের কাছে সরকারের ব্যাখ্যানুযায়ী সংবাদ উপস্থাপন করা কঠিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
গুজরাট ভিত্তিক ইংরেজি পত্রিকা দ্য হিন্দু'র সাংবাদিক মহেশ লাঙ্গা বলেন, "মহামারির কারণে ৯৯ শতাংশ জনগোষ্ঠীই চিন্তিত। তারাও (গণমাধ্যম মালিকপক্ষ) ধূর্ত ব্যবসায়ী এবং তারা জানে যে, এই মুহূর্তে সরকারি বক্তব্যের সাথে সম্মত হওয়ার কোনো মানে হয় না।"
তবে, সরকারি বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমের আয়ের মূল উৎস হওয়ায়, মোদি বিরোধিতার কারণে পত্রিকাগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষত, মহামারির কারণে অর্থনীতি স্বাভাবিক গতি হারানোর ফলে অন্যান্য বিজ্ঞাপনদাতারাও এখন কড়াঘাতের সম্মুখীন হয়েছে।
অন্যদিকে, গণমাধ্যমের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং সম্পাদকীয় কার্যক্রমের মাঝে দেওয়াল থাকলেও, জটিল পরিস্থিতিতে এই পরিবেষ্টনীও চাপের মুখে পড়তে পারে।
ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের প্রধান গণমাধ্যমগুলোর সাথে অন্যান্য শিল্পখাতের স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা আছে। সংগঠনটির তথ্যানুযায়ী, "অধিকাংশ প্রভাবশালী গণমাধ্যম বিভিন্ন শিল্পে বড় বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠাকালীন পরিবার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।"
যেমন, দৈনিক ভাস্কর পত্রিকা গোষ্ঠীর মালিকানা যে পরিবারটির হাতে, তাদের আবাসন থেকে শক্তিখাতের বিভিন্ন ধারার ব্যবসায় অংশীদারী আছে। এশিয়ার শীর্ষ ধনী ও রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান মুকেশ আম্বানির অধীনে আছে নেটওয়ার্ক ১৮। সিএনএন অনুমোদিত টেলিভিশন চ্যানেল সিএনএন-নিউজ ১৮ এই নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত।
বহু টেলিভিশন চ্যানেল এবং সংবাদপত্র প্রচারকদের ক্ষমতাসীন দলের সুনজরে থাকতে হয় বলে মন্তব্য করেন শেখরি। সরকারের প্রসঙ্গ আসলে তারা 'সতর্ক ভূমিকা' অবলম্বন করে থাকে। কেননা, শিল্প গোষ্ঠীগুলো টেলিকম খাত থেকে শুরু করে জ্বালানি তেল পর্যন্ত বিভিন্ন ধারার বাণিজ্যের জন্য সরকারের সহায়ক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার মুখাপেক্ষী।
তবে, মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়তে থাকায় সংবাদ মাধ্যমের চাটুকারিতা করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে বলেও মন্তব্য করেন শেখরি।
তিনি বলেন, "তারা জানে যে, সত্য প্রকাশ না করলে রাস্তায় গিয়ে তাদের প্রতিবেদকরা আক্রমণের শিকার হতে পারে।"
তবে, সত্য প্রকাশ করেও ফেঁসে যেতে পারেন সাংবাদিকরা। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের তথ্যানুযায়ী, "যথাযথ দায়িত্ব পালনে প্রচেষ্টারত সাংবাদিকদের জন্য ভারত বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক দেশ।" সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ক সূচক ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি অঞ্চলের মধ্যের ভারতের অবস্থান ১৪২ তম।
বাক- স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ভারতীয় সংগঠন- ফ্রি স্পিচ কালেক্টিভ পরিচালিত এক বিশ্লেষণ অনুসারে, "গত এক দশকে ভারতে পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ১৫৪ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার, আটক, জিজ্ঞাসাবাদ কিংবা কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে, ৬৭টি ঘটনা শুধুমাত্র ২০২০ সালেই লিপিবদ্ধ করা হয়।"
প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও, বহু ভারতীয় সাংবাদিক সত্য প্রকাশে অবিচল থাকার চেষ্টা করে চলেছেন। গত সপ্তাহে, দিল্লিভিত্তিক ম্যাগাজিন পত্রিকা আউটলুকের নতুন একটি প্রচ্ছদ টুইটারে ব্যাপক সাড়া ফেলে। নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান চেয়ে প্রচারিত পোস্টারের ন্যায় প্রচ্ছদ প্রকাশ করে ম্যাগাজিনটি সরকারের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনায় অবতীর্ণ হয়।
- সূত্র: সিএনএন
- অনুবাদক: তামারা ইয়াসমীন তমা