যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে টিকাকরণে কেন আরও পিছিয়ে পড়ছে এশিয়া?
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অনেক স্থানেই কোভিড-১৯ সংক্রমণে দেখা যাচ্ছে ঊর্ধ্বগতি, কোথাও কোথাও সংক্রমণ গড়ছে নতুন রেকর্ড। কিন্তু, সেই তুলনায় জনসংখ্যাকে টিকাকরণে এখনও হিমশিম খাচ্ছে অধিকাংশ দেশ।
এব্যাপারে হংকং ইউনিভার্সিটির জনস্বাস্থ্য অনুষদের অধ্যাপক বেঞ্জামিন কাউলিং বলেন, প্রতিষেধকের চালান নিশ্চিত করতে গিয়েই সমস্যার মধ্যে পড়েছে বেশিরভাগ এশীয় দেশের সরকার। তাছাড়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে মহামারির প্রথম বছরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যে সফলতা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পায়, তাতে অনেক নাগরিক কোভিডের ভয় কাটিয়ে উঠেছেন। তারা টিকা নিতে খুব একটা আগ্রহও দেখাচ্ছেন না। তাই যেসব দেশের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ আছে, নাগরিকদের সাড়া না থাকায় সেখানে গতি হারাচ্ছে টিকাকরণ।
"গেল বছর যখন হংকংয়ে খুব কম সংক্রমণ ছিল, তখন আমাদের এখানকার বাসিন্দারা ধারণা করেছিলেন কোভিড-১৯ হয়তো কোন বড় ধরনের হুমকি হবে না। তাছাড়া, মাস্ক পড়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই কেস সংখ্যা শূন্যতে রাখা সম্ভব এমন ধারণাও বদ্ধমূল হয়। ফলে টিকা নিতে কারো মধ্যে তাড়া ছিল না। এই দ্বিধাটি একটি বড় সমস্যা," গত মঙ্গলবার মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসি'র 'স্কোয়ক বক্স এশিয়া' অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এসব কথা বলছিলেন কাউলিং। তিনি হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিদ্যা ও জৈব পরিসংখ্যান বিভাগেরও প্রধান।
সোজা কথায়; সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সফলতা থেকে টিকাকরণে পিছিয়ে থাকার প্রতীক হয়ে উঠেছে এশিয়ার এই অঞ্চল- ন্যাটিসিক্স"
তবে সবখানে টিকা নিয়ে দ্বিধা ও অনাস্থা প্রধান কারণ নয়, বিশেষ করে এশীয় যেসব দেশে সংক্রমণের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে তাদের সকলের ক্ষেত্রেই একথা খাটে না।
গত মাসে রেকর্ড সংখ্যক সংক্রমণ শনাক্ত হয় ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, জাপান এবং তাইওয়ানে। এই অবস্থায় ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে নতুন করে বিধি-নিষেধ আরোপ করে স্থানীয় প্রশাসন।
ভারতে রয়েছে টিকা ডোজের ব্যাপক সঙ্কট। এনিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশটির টিকাদান কর্মসূচি।
এশিয়ার কোভিড টিকাকরণ:
তথ্য-পরিসংখ্যান ওয়েবসাইট 'আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা'র গত ১ জুন নাগাদ প্রদত্ত তথ্যাবলী বিশ্লেষণ করেছে সিএনবিসি। বিশ্লেষণে উঠে আসে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সব দেশ মিলিতভাবে প্রতি ১০০ জনে ২৩.৮টি করে টিকার ডোজ দিয়েছে। উত্তর আমেরিকায় ডোজ প্রদানের হার ৬১.৪ আর ইউরোপে ৪৮.৫। স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে কম ডোজ দেওয়া হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে, সেখানে প্রতি ১০০ জনে ডোজের হার ২.৫টি।
ফরাসী ব্যাংক ন্যাটিসিক্স- এর অর্থনীতিবিদেরা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে টিকা সরবরাহ ও টিকাকরণের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা জানান, গত মাসে সরবরাহ কম পাওয়ার কারণেই এই অঞ্চলে টিকাকরণ ধীর গতির হয়ে পড়েছিল, ভারতের মতো কিছু দেশ এখনও সে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
এছাড়া, "জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কোভিড প্রতিষেধকের ডোজ সংগ্রহে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের মতো দেশও ব্যর্থ হয়েছে," বলে জানান তারা।
ন্যাটিসিক্স- এর এক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, "ডোজের সরবরাহ একটি বড় সমস্যা হলেও, জনগণের মধ্যে টিকা নেওয়ার চাহিদা না থাকাটিও অন্যতম প্রতিবন্ধক। তাছাড়া, নতুন আবিষ্কৃত টিকা নিয়ে সংশয় এবং সেগুলোর ওপর আস্থাহীনতা একটি বৈশ্বিক প্রবণতা। তবে এশিয়ার কিছু দেশে সংক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা কার্যকর হওয়ায়, অনেকেই টিকা নেওয়াকে বেশি জরুরি মনে করছেন না।"
টিকাকরণে অগ্রসর ও পশ্চাদপদ দেশসমূহ:
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রতি ১০০ জনে ৯৭টি ডোজ দিয়ে সবার আগে রয়েছে মঙ্গোলিয়া। ৬৯টি ডোজ দিয়ে তারপরের স্থানটি সিঙ্গাপুরের দখলে।
পিছিয়ে থাকা দেশের মধ্যে রয়েছে দুর্বল বা প্রান্তিক অর্থনীতির আফগানিস্তান ও উদীয়মান অর্থনীতি ভিয়েতনাম।
এশিয়ার বেশকিছু প্রান্তিক ও উদীয়মান অর্থনীতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) কোভ্যাক্স কর্মসূচির ওপর টিকা সরবরাহ পেতে নির্ভর করছে, বলে বাণিজ্যিক গবেষণা সংস্থা ফিচ সল্যিউশন্স এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনটি আরও জানায়, ভারতের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তে দুর্বল হয়েছে কোভ্যাক্সের সরবরাহ চক্র। ইতঃপূর্বে ভারতের সেরাম ইনসটিটিউটকে মূল সবরাহক হিসেবে কোভ্যাক্সে যুক্ত করেছিল হু।
ফিচ সল্যিউশন্স সতর্ক করে বলেছে, "খুব শিগগির ভারত থেকে রপ্তানি সচল না হলে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের দেশে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে ভ্যাকসিন সরবরাহ আরও পিছিয়ে যাবে, ফলে টিকাকরণেও অচলাবস্থা দেখা দেবে।"
এশিয়ার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বনাম পশ্চিমা দেশের চিত্র:
টিকাদানের বর্তমান হার অনুসারে ন্যাটিসিক্সের অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, চলতি বছর এশিয়ায় শুধুমাত্র চীন ও সিঙ্গাপুর তাদের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে টিকা দিতে সক্ষম হবে। একইসময়ে, অনুরূপ টিকাকরণ হার অর্জন করবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো পশ্চিমের উন্নত রাষ্ট্র।
জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে এভাবে টিকার আওতায় আনা গেলেই গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা অর্জন করা সম্ভব বলে অধিকাংশ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন। কারণ, অধিকাংশ মানুষ টিকার আওতায় আসলে তখন ভাইরাস সহজে বিস্তার লাভ করতে পারে না।
তবে এশিয়ার যেসব দেশ এখনও টিকাকরণ নিয়ে যুঝছে তারা ২০২৫ সাল বা তারও অনেক পড়ে গিয়ে গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা অর্জন করবে বলে ফরাসী ব্যাংকটির অর্থনীতিবিদেরা অনুমান করছেন।
টিকাকরণের দুর্বল গতি এশিয়ার কিছু দেশকে অন্যান্যদের তুলনায় বেশি প্রভাবিত করবে বলেও জানান ন্যাটিসিক্সের অর্থনীতিবিদেরা। তারা বলছেন, পর্যটন নির্ভরতা থাকার পাশাপাশি, মহামারি মোকাবিলায় অদক্ষতার পরিচয় দেওয়া ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিতে টিকাদানের গতি বৃদ্ধি দরকার।
"সোজা কথায়; সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সফলতা থেকে টিকাকরণে পিছিয়ে থাকার প্রতীক হয়ে উঠেছে এশিয়ার এই অঞ্চল" ন্যাটিসিক্স প্রতিবেদনে বলা হয়। সব মিলিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ, আন্তঃসীমান্ত চলাচলের বিধিনিষেধ পশ্চিমা দেশের তুলনায় আরও অনেকদিন বজায় থাকবে বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়।
"যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা দেশসমূহে অর্থনীতির পুনঃউন্মুক্তকরণ পরিস্থিতি অতি দ্রুত টিকাকরণের ওপর ভর করে তৈরি হয়েছে। ইউরোপিয় ইউনিয়নও সেদিকে এগিয়ে চলেছে, এর ফলে এশিয়ার তুলনায় একটি বিপরীত চিত্র তৈরি হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীদের কাছে এশিয়ার অবস্থান দুর্বল হবে এবং তারা নতুন বিনিয়োগেও খুব একটা উৎসাহী হবেন না।"
- সূত্র: সিএনবিসি