যেভাবে ব্যর্থ হলো ভারতের ভ্যাকসিন কর্মসূচী
অর্ধেকটা দিন সময় ব্যয় করার পর ৩১ বছর বয়সী ভারতীয় নাগরিক স্নেহা মারাথে অনলাইনে কোভিড ভ্যাকসিনের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে সক্ষম হন।
তিনি বলেন, বিষয়টি ছিল একটি খেলার মতো। যার আঙ্গুল যত দ্রুত গতিতে চলবে, সেই আগে রেজিস্ট্রেশন করাতে পারবেন।
"তিন সেকেন্ডের মধ্যেই ভ্যাকসিনের জন্য বরাদ্দকৃত স্থান পূর্ণ হয়ে যায়," বলেন স্নেহা। তবে, রেজিস্ট্রেশন করানোর পরও শেষ মুহূর্তে তা বাতিল হয়ে যায়।
ভ্যাকসিন মজুত না থাকায় রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। স্নেহা মারাথে আরেকটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে ক্লান্তিকর সেই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি শুরু করেন।
ভারতে ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের টিকা নিতে চাইলে সরকারের 'কোউইন' নামক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করাতে হয়। এমনকি, সরবরাহের তুলনায় চাহিদার মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায়, প্রযুক্তি নিয়ে মোহাবিষ্ট ভারতীয়রা বহুল প্রত্যাশিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে কোড লিখে চলেছেন।
স্নেহা মারাথে কোড লিখতে জানেন না। তবে, তারপরও তিনি ভারতের ডিজিটাল বিভাজনের দিক থেকে সুবিধাপ্রাপ্তদের তালিকায় আছেন। ভারতে এখনও লাখ লাখ মানুষ আছেন যাদের কাছে স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট নেই। অথচ, টিকা নিতে চাইলে বর্তমানে স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া রেজিস্ট্রেশনের বিকল্প উপায় নেই।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ৯৬ কোটি মানুষের টিকাদান কর্মসূচী চালু করেছে। অথচ, টিকার সরবরাহের পরিমাণ চাহিদার ধারেকাছেও নেই।
টিকার এই সংকটের কথা এমন সময় শোনা যাচ্ছে যখন চলমান ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউ ছাড়িয়ে আসন্ন তৃতীয় ঢেউ নিয়ে সতর্কতা জারি হয়েছে।
দুর্বল পরিকল্পনা, খণ্ডাকার ক্রয় ব্যবস্থাপনা এবং অনিয়ন্ত্রিত মূল্য নির্ধারণ- সব মিলিয়ে মোদি সরকার এমন ঘোট পাকিয়েছে যে ভারতের টিকাদান কর্মসূচী এখন এক গভীর অসম প্রতিযোগিতায় নিমজ্জিত।
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারী দেশ যাকে প্রায়শই 'বিশ্বের ফার্মেসি' বলে ডাকা হয়। এমন একটি দেশ কী করে ভ্যাকসিন সংকটের পড়ল?
বিচ্ছিন্ন কৌশল
ভারত, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় চিকিৎসা সামগ্রী সহজলভ্য করে তোলার লক্ষ্যে গঠিত প্রচার সংগঠন অ্যাকসেস আইবিএসএ'র সমন্বয়কারী অচল প্রভালা বলেন, "ভারত ভ্যাকসিনের ক্রয়াদেশ জারি করতে জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করে। অথচ দেশটি আগে থেকেই অর্ডার দিয়ে রাখতে পারত। এমনকি তারা ক্রয়ও করে খুব সীমিত পরিমাণে।"
২০২১ সালের জানুয়ারি এবং মে মাসের মাঝামাঝি ভারত সেরাম ইন্সটিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড এবং ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বায়োটেকের কোভ্যাক্সিনের বড়জোর ৩৫০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন ক্রয় করে। প্রতি ডোজের দাম ছিল দুই ডলার করে। বিশ্বে সবথেকে কমদামে ভ্যাকসিন মিলেছে এখানেই। কিন্তু, এত কম পরিমাণ ভ্যাকসিন দিয়ে দেশের মাত্র ২০ শতাংশ জনগণকেও টিকা প্রদান সম্ভব ছিল না।
ভারত কোভিড জয় করেছে এই ঘোষণা দিয়ে নরেন্দ্র মোদি 'ভ্যাকসিন কূটনীতি' আরম্ভ করেন। মার্চ নাগাদ ভারতে যে পরিমাণ টিকাদান হয়েছে, তার থেকেও বেশি পরিমাণ ভ্যাকসিন মোদি রপ্তানি করেন।
অথচ, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভ্যাকসিন আসার পর নিজেদের চাহিদার চাইতেও অধিক পরিমাণ ভ্যাকসিন আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখে।
ভারতের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের ধারেকাছেও ছিল না। দেশটি ভ্যাকসিন উৎপাদন বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় ঢেউ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। অবশেষে, গত ২০ এপ্রিল সেরাম এবং বায়োটেককে ভ্যাকসিন উৎপাদনে ৬১০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন বরাদ্দ করা হয়।
বর্তমানে, তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ চারটি প্রতিষ্ঠানে কোভ্যাক্সিন উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, এপ্রিলের শুরুতে ভারতে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি'র উৎপাদন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ভেঙে পড়া ভ্যাকসিন বাজার
প্রাথমিকভাবে একক ক্রেতা হিসেবে ভারতের ফেডারেল সরকারের মূল্য নির্ধারণের যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল বলে মন্তব্য করেন অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্কের সহ-আহ্বায়ক মালিনী আয়সোলা।
তিনি বলেন, "কেন্দ্রীয়ভাবে বড় আকারের ক্রয়চুক্তি করলে ভ্যাকসিনের মূল্য দুই ডলারের নিচে নেমে আসত। পরিবর্তে, তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।"
পয়লা মে থেকে রাজ্য সরকার এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে মুক্তবাজার অনুযায়ী দাম নির্ধারণের মাধ্যমে প্রস্তুতকারকদের থেকে ভ্যাকসিন ক্রয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর সে কারণেই ভ্যাকসিনের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
ভারতের বিরোধী দলগুলো বিষয়টিকে 'কেলেঙ্কারি' হিসেবে উল্লেখ করেছে। দলগুলোর অভিযোগ, সরকার রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে নিজেরা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছে।
কোভিশিল্ডের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার অপেক্ষা রাজ্য সরকারকে দ্বিগুণ মূল্য পরিশোধ করতে হবে। রাজ্য সরকার প্রতি ডোজ কোভিশিল্ড ৪ ডলার মূল্যে কিনছে।
অন্যদিকে, কোভ্যাক্সিনের জন্য এই মূল্য চারগুণ বেশি। রাজ্য সরকারকে ৮ ডলার মূল্যে প্রতি ডোজ কোভ্যাক্সিন কিনতে হচ্ছে।
এমনকি, এই মূল্যও প্রতিষ্ঠানগুলো 'জনস্বার্থে' ভ্যাকসিনের মূল্য কমানোর পর ধরা হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাকসিন মূল্যের পুরোটাই গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করে নিতে পারছে। কিন্তু, রাজ্য সরকার এবং বেসরকারি হাসপাতাল-উভয় স্থানেই চলছে ভ্যাকসিন সংকট।
জনসাধারণ ও বেসরকারি উভয় অর্থায়নে গড়ে ওঠা ভ্যাকসিন উৎপাদন ব্যবস্থাপনা স্পষ্টভাবেই এখন এক মুক্তবাজারে পরিণত হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের জন্য ২০ ডলার বা ১৫০০ রুপির বেশি গুনতে হচ্ছে।
অনেক রাজ্যই এখন নিজ উদ্যোগে ফাইজার, মডার্না এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন কেনার ঘোষণা দিয়েছে। তবে, ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোন প্রতিষ্ঠানই
আগামী কয়েক মাসের ভেতর সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। উন্নত দেশগুলো আগে থেকেই ক্রয় চুক্তি করে রাখায় খুব দ্রুত এসব ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ভারতে অনুমোদন লাভ করেছে। কিন্তু কবে থেকে স্পুটনিকের টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে তা এখনো অনিশ্চিত।
- বিবিসি অবলম্বনে