সংক্রমণ সংখ্যা বাড়ায় ফুরিয়ে আসছে এশিয়ায় হাসপাতালের শয্যা
করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপুল চাপের মুখে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানেও শোনা গেছে হাসপাতালে শয্যা সঙ্কটের খবর। কিন্তু, এই প্রভাব থেকে মুক্ত নয় এশিয়া মহাদেশের জনবহুল অন্যান্য রাষ্ট্রও। প্রতিবেশী ভারতও নাজেহাল দ্বিতীয় ঢেউয়ে, আজ বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) ভারত ও থাইল্যান্ডে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যায় নয়া রেকর্ড হয়েছে। তার সঙ্গেই দেখা দিয়েছে হাসপাতালের শয্যা ও ভ্যাকসিন ডোজ সঙ্কটের ঘটনা। এসব কিছুর মিলিত প্রভাবে মহামারির করাল গ্রাস থেকে এশিয়ার অর্থনৈতিক উত্তরণ হয়ে উঠছে অনিশ্চিত।
বৃহস্পতিবার ভারতের কেন্দ্রীয় জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ২ লাখ জন আক্রান্ত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করে। লকডাউন ফিরে এসেছে দেশটির বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র মুম্বাইয়ে। অন্যদিকে, স্থানীয় গণমাধ্যমের সংবাদে শোনা যাচ্ছে হাসপাতালগুলোয় শয্যা ও অক্সিজেন সরবরাহ সঙ্কটের কথাও।
এব্যাপারে মহারাষ্ট্রের আরেকটি অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র নাগপুরের সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এক কর্মকর্তা অবিনাশ গোন্ডে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদককে বলেন, "এখানকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। আমাদের হাসপাতাল ৯০০ শয্যার হওয়া সত্ত্বেও এখনও ৬০ জন রোগী ভর্তি হওয়ার অপেক্ষা করছেন। অনেক চেষ্টা করেও তাদের জন্য স্থান সঙ্কুলানের ব্যবস্থা করতে পারছি না।"
গত আটদিনে দৈনিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে টানা সাতটি রেকর্ড হয়েছে ভারতে, আর সবচেয়ে বেশি মানুষ শনাক্ত হচ্ছেন মহারাষ্ট্রেই। মারাত্মক এই সংক্রমণ গতির কারণে ভারতের মোট কোভিড কেস সংখ্যা এক কোটি ৪১ লাখে উন্নীত হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পর আবারও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ কোভিড-১৯ প্রভাবিত দেশের স্থান পেয়েছে ভারত।
এরমধ্যেই আবার গত বুধবার লাখ লাখ পুণ্যার্থী উত্তর ভারতের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেন, যেকারণে কোভিড-১৯ কেস সংখ্যা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এশিয়ার অপর দেশ ফিলিপাইনও লক্ষ্য করছে হাসপাতাল ব্যবস্থার উপর প্রচণ্ড চাপ। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলাসহ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের স্বাস্থ্যখাতও হিমশিম খাচ্ছে রোগীর ভিড়ে।
ফিলিপাইনের রাজধানীর বাসিন্দা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ, সেখানকার হাসপাতালগুলো যত দ্রুতগতিতে ভরে যাচ্ছে, সেই তুলনায় হাসপাতাল শয্যা তেমনভাবে খালি হচ্ছে না। আর কেস সংখ্যা কমারও কোনো লক্ষণ নেই। শুধুমাত্র গত ৩০ দিনে সেখানে নিশ্চিত শনাক্ত করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২.৬৬, ৪৮৯ জনে। মহামারি আঘাত হানার পর এটি দেশটির মোট সংক্রমণ সংখ্যার ৩০ শতাংশ!
হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে অনেক রোগীর আত্মীয়-পরিজন সামাজিক মাধ্যমে তাদের দুর্দশা ও ভোগান্তি তুলে ধরছেন। অনেকেই জানান, রোগী নিয়ে রাজধানী থেকে অনেক দূরে হাসপাতালের শয্যা খুঁজতে যাওয়া বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মরণাপন্ন রোগী নিয়ে অপেক্ষার মতো দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথাও।
বৃহস্পতিবার থাইল্যান্ডে ১,৫৪৩টি নতুন সংক্রমণের কথা জানায়, সেখানে মহামারি আঘাত হানার পর এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যক কেস সংখ্যা। আর গেল চার সপ্তাহের মধ্যে এটি ছিল চতুর্থ রেকর্ড বৃদ্ধির ঘটনা।
ভাইরাসের বিস্তারে হাসপাতাল শয্যাপূরণের হার বেড়েছে, কারণ থাইল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য নিয়ম অনুসারে পজিটিভ শনাক্ত সকল রোগীকে হাসপাতালে থেকেই চিকিৎসা নিতে হয়। এখন মোট ৮,৯৭৩ জন রোগী থাই হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিচ্ছেন।
দেশটির সরকার নতুন করে লকডাউনের ব্যাপারে চিন্তা করলেও, বৃহস্পতিবার প্রতিবেশী রাষ্ট্র কম্বোডিয়া রাজধানী নম্পেনসহ একটি জেলায় লকডাউন চালু করে। গেল ফেব্রুয়ারির পর একটি আঞ্চলিক প্রাদুর্ভাব দেশব্যাপী বিস্তারের প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, গত দুই মাসের মধ্যে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ৪,৮৭৪ জন কম্বোডীয়।
এছাড়া, বাংলাদেশ যাচ্ছে সপ্তাহব্যাপী কঠোর লকডাউনের মধ্যে দিয়ে। বুধবার নাগাদ গত দুই সপ্তাহে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা গড়ে প্রায় ৭ হাজারে পৌঁছায়, অথচ ফেব্রুয়ারিতে তা ছিল ৩০০ এর নিচে।
ভ্যাকসিন স্বল্পতা:
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ব্যবধান বেড়েই চলেছে। এনিয়ে গত বুধবার জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-হু'র প্রধান উন্নত দেশের টিকা আবিষ্কারক কোম্পানিগুলোর প্রতি উন্নয়নশীল দেশে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির আহবান জানিয়েছেন।
উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের ব্যবধান সহজেই চোখে পড়ছে টিকাদানের হারে নজর দিলে, যেমন; থাইল্যান্ড তার মোট জনসংখ্যার মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশকে টিকা দিতে পেরেছে। অথচ আঞ্চলিক ধনী দেশ সিঙ্গাপুরের ১৪.৬ শতাংশ নাগরিক টিকা পেয়েছেন, বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স তাদের নিজস্ব ডেটাবেজ সূত্রে জানায়।
গেল মার্চে প্রথম আফ্রিকান নারী হিসেবে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেওয়া এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা সদস্য দেশগুলোর প্রতি ভ্যাকসিন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিলের পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থা এবং কাস্টমস বিধিমালা সহজ করার আহবান জানান। যদিও সেই আহবানে টিকা উৎপাদন কেন্দ্র থাকা দেশগুলো সেভাবে সাড়া দেয়নি।
সরবরাহ সঙ্কট এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ধনী দেশকেও ভোগান্তির শিকার করেছে। যেমন; একটি বড় চালান আসতে দেরি হওয়ায় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার উপর নতুন করে আরোপিত কিছু নিষেধাজ্ঞার কারণে চলতি সপ্তাহেই মোট টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা বাতিল করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। দেশটির চিকিৎসকদের একটি জোট অবশ্য অবকাঠামো ও কর্মী সঙ্কটের কথা তুলে ধরে সরকারের ব্যাপক টিকাদানের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে।
অস্ট্রেলিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ওমর খোরশিদ স্থানীয় একটি বেতার চ্যানেলে বলেন, "বড় পরিসরে টিকাদানে অনেকগুলো কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সেখানে দরকার হবে বিপুল সংখ্যক নিবন্ধিত চিকিৎসক ও নার্সের। সরকার এ ব্যাপারটি আগেই চিন্তা করেননি বলে আমরা মনে করছি।"
ডোজ সরবরাহ চাপের মুখে থাকায় আরেক উন্নত দেশ জাপানেও টিকাদানের গতি ব্যাহত হচ্ছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি খুব বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠলে চলতি বছরের নির্ধারিত টোকিও অলিম্পিক আয়োজন বাতিল করা হতে পারে বলে আজ বৃহস্পতিবার সরকারি দলের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন। অলিম্পিক অনুষ্ঠানের আর মাত্র ১০০ দিনের কম সময় থাকতেই তিনি একথা জানালেন।
"অলিম্পিক আসর অনুষ্ঠান করা যদি অসম্ভব হয়ে ওঠে, তাহলে বাধ্য হয়েই আমাদের তা বন্ধ করতে হবে," তিনি বলেছেন।
জাপানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে আবারও, সরকারের তরফ থেকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ধরা পড়ছে রাজধানী টোকিওতে। আরেক জনবহুল নগরী ওসাকাও রেকর্ড সংখ্যক সংক্রমণের শিকার।
- সূত্র: রয়টার্স